শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফের সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা। তিন বছরে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার। অবশ্য সেই চেষ্টা এ বারও ব্যর্থ হয়েছে, এবং তা সেনার তৎপরতাতেই। আজ সেনাবাহিনীর তরফে এই সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্রের খবর জানিয়ে বলা হয়েছে, মৌলবাদীরাই সরকারকে ফেলার জন্য সক্রিয় হয়েছিল। মুখে না বললেও সেনাকর্তাদের সন্দেহ, এই ঘটনার পিছনে পাকিস্তানের মদতপ্রাপ্ত জামাত-ই-ইসলামি এবং হিজবুর তাহরির জড়িত। এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখনও পর্যন্ত দুই অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নজর রাখা হয়েছে বিভিন্ন স্তরের আরও অন্তত ৩০ জন সেনার উপরে। |
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পরেই ২০০৯-এ বিডিআর বিদ্রোহে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ। সরকারের হস্তক্ষেপে দিন দু’য়েক পর দেশে শান্তি ফিরলেও বিদ্রোহী সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ-সহ বহু সেনা ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়। নতুন সরকারের কাছে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলাই ছিল তখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষত বিডিআর যে হেতু সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, সে কারণে পরিস্থিতি একটু বেশিই স্পর্শকাতর ছিল। এ বারও সেনারই একটি অংশ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেছে বলে তদন্তে জানতে পেরেছেন সেনাকর্তারা।
ষড়যন্ত্রের খবর জানিয়ে বাংলাদেশ সেনার মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মহম্মদ মাসুদ রজ্জাক আজ বলেন, “কিছু প্রাক্তন এবং বর্তমান সেনা অফিসার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে বলে সেনার কাছে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। সেনাবাহিনীর পলাতক মেজর সৈয়দ মহম্মদ জিয়াউল হকের সঙ্গে ওই সেনা অফিসারেরা ফোন এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছিলেন।” অভিযুক্ত সেনাদের ‘কট্টর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির’ কথাও জানিয়েছেন রজ্জাক। সেনা সূত্রে জানানো হয়েছে, যে দু’জন প্রাক্তন সেনা অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এহসান ইউসুফ এবং মেজর জাকির।
গোটা ঘটনায় পাক মদতপ্রাপ্ত জামাতের পরোক্ষ হাত রয়েছে বলে মনে করছে ঢাকা। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য আজ এ নিয়ে সরাসরি পাকিস্তানের কথা টানেননি। তিনি বিরোধী বিএনপি-র দিকেই আঙুল তুলেছেন। হাসিনা এ দিন বলেছেন, “বিএনপি আন্দোলনের নামে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নষ্ট করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।” হাসিনা-সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের খবরে উদ্বিগ্ন নয়াদিল্লিও। সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসফ)-কে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তে বাংলাদেশ সরকার জানতে পেরেছে, এই ষড়যন্ত্রে জামাতের পরোক্ষ মদত থাকলেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছে হিজবুর তাহরির। ২০০৩ সালে গড়ে ওঠা এই হিজবুর তাহরিরকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের একাধিক শীর্ষ কর্তা এখনও জেলে। তা সত্ত্বেও এই সংগঠনের বিস্তার আটকানো যায়নি। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে এই সংগঠনটির প্রভাব যথেষ্ট। একই সঙ্গে সংগঠনটি তীব্র ভারত-বিরোধী প্রচার চালায়। বিরোধী দলনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেকও এর পিছনে অন্যতম মস্তিষ্ক বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। সে কারণেই তারা ‘ভারতবন্ধু’ হাসিনাকে সরাতে মরিয়া। নিষিদ্ধ সংগঠন হয়েও হাসিনা-বিরোধী এই প্রচার, ঝটিকা-মিছিল চালিয়ে যায় তারা। এদের পিছনে সেনা, শিক্ষকমহল, নাগরিক সমাজ ও আমলাদের একাংশের মদত রয়েছে বলেও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। সে কারণেই নিষিদ্ধ করার পরেও বাংলা ভাইয়ের সংগঠনের মতো এদের বিরুদ্ধে একই রকম কার্যকরী পদক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি।
হিজবুরের পিছনে মদত রয়েছে জামাতেরও। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক যতটাই এগিয়ে নিয়ে
|
জিয়াউল হক |
যেতে চেয়েছেন হাসিনা, ততই দেশের মধ্যে বিরোধিতায় সরব হয়েছে জামাত। টিপাইমুখ বাঁধ থেকে তিস্তা চুক্তি--- প্রতিটি বিষয়েই প্রকাশ্য বিরোধিতা করে তারা অভিযোগ জানিয়েছে, ভারতের কাছে স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছে হাসিনার সরকার। সম্প্রতি আগরতলা সফরে গিয়ে শেখ হাসিনা
বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে সরবও হন। বলেছিলেন, পালাটানা প্রকল্পে ভারতকে সাহায্য করার জন্য তাঁর বিরোধীরা সমালোচনা করলেও তিনি ‘পড়শির সমস্যা’ দেখে হাত গুটিয়ে থাকবেন না।
এটা ঠিকই যে, হাসিনা অটল থাকলেও দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ক্রমশই অগ্নিগর্ভ হয়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে সেনা অভ্যুত্থানের এই ছক ফাঁস হওয়ায়। আজ বিকেলে ঢাকায় যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করে বাংলাদেশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহম্মদ সাজ্জাদ ষড়যন্ত্রের কথাটি জানান।
কিন্তু কী ভাবে জানা গেল এই সম্ভাব্য এই সেনা অভ্যুত্থানের ছক? সেনা সূত্রে খবর, গত ১৩ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর এক মেজর সেনার মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর এই পরিকল্পনার কথা জানতে পারেন। ওই মেজরের নাম অবশ্য জানা যায়নি। তাঁকে এক প্রাক্তন সেনা অফিসার তাঁদের দলের সঙ্গে হাত মেলাতে বলেন। ওই মেজর বিষয়টি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান। তার পরেই প্রাক্তন ওই সেনা অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর প্রায় এক মাস ধরে সেনার বিভিন্ন পর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে সম্ভাব্য এই সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এই ষড়যন্ত্রের আরও এক অংশীদার মেজর সৈয়দ মহম্মদ জিয়াউল হকের ছুটি ও বদলি বাতিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে ধরা যায়নি। তিনি পালিয়ে গিয়ে পুরোদস্তুর সরকার-বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত হয়েছেন বলে খবর। শুধু তা-ই নয়, সেনার আরও একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি মানবতা-বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে জামাতে ইসলামির প্রাক্তন প্রধান গোলাম আজমকে। তাঁর কাছ থেকেও এই ধরনের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তথ্য মিলেছে বলেও মনে করা হচ্ছে। |