ধান ও আলুর দর না পেয়ে ফের এক চাষির আত্মহত্যার অভিযোগ উঠল বর্ধমানে। আর একই দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের দাবি করলেন, রাজ্যে কৃষিজমি বা ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে এক জনও আত্মঘাতী হচ্ছেন না।
রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ বলে পরিচিত বর্ধমানের পূর্বস্থলী ও কালনায় গত সপ্তাহে দুই চাষি আত্মঘাতী হন। দু’দিনের মধ্যে তার পুনরাবৃত্তি ঘটে আর এক উর্বর জেলা হুগলির হরিপালে। গলসির হিট্টা গ্রামের আলু ও ধান চাষি সুশান্ত ঘোষ (৩৪) এই তালিকায় নবতম সংযোজন।
বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের পঞ্চায়েতি-রাজ সম্মেলনে মমতা বলেন, “যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের কারও অসুস্থতা ছিল। কেউ কেউ ঋণগ্রস্ত ছিল। কারও পারিবারিক কারণ ছিল। চাষের সঙ্গে যোগ থাকার কোনও নথি ওই ব্যক্তিদের নামে মেলেনি।” বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র পাল্টা বলেন, “এ পর্যন্ত ২৩ জন কৃষকের আত্মহত্যার রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি। প্রত্যেকটি জায়গায় আমরা যাব। ওঁরা তথ্য সংগ্রহের বদলে দায় অস্বীকার করছেন!”
পরিবার সূত্রে জানা যায়, সুশান্তবাবুর নিজের সাত-আট বিঘে জমি আছে। সেই সঙ্গে আরও সাত-আট বিঘেতে ভাগচাষ করতেন। পরপর তিনটি চাষে মার খেয়ে ঋণের জালে আকণ্ঠ জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। মঙ্গলবার রাতে কীটনাশক খান। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও বুধবার সন্ধ্যায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর বাবা বিকাশচন্দ্র ঘোষের বক্তব্য, “ধান ও আলু চাষে বিপর্যয়ের জেরে প্রচুর ঋণ হয়ে গিয়েছিল। তার পরিণতিতেই আমার ছেলে আত্মঘাতী হয়েছে।”
সুশান্ত ঘোষ |
মুখ্যমন্ত্রীর মতোই বর্ধমান জেলা প্রশাসনও অবশ্য চাষে বিপর্যয়কে আত্মহত্যার কারণ বলে মানতে নারাজ। জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনার দাবি, “মৃতের আত্মীয়েরা জানিয়েছেন, দেড় বছর আগে থেকেই ওই চাষির ‘মানসিক ভারসাম্যহানির লক্ষণ’ দেখা গিয়েছিল এবং ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল। বর্ধমান থানার পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে।” মৃতের বাবা পাল্টা বলেন, “ওর কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারত না। তাই ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেত।” স্থানীয় খানো পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি কুন্তল দত্তও বলেন, “আমাদের কখনই মনে হয়নি যে উনি অসুস্থ। বরং চাষের বীজ, সার ইত্যাদি নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল। নিয়মিত পঞ্চায়েতে এসে খোঁজখবর নিতেন।”
চাষে বিপর্যয়কে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে না মানলেও একাধিক জায়গায় সুশান্তবাবুদের দেনা ও তা শোধ করতে না পারার কথা অবশ্য জেলাশাসক স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “২০০৯ সালের মার্চে ও জুনে স্টেট ব্যাঙ্কের তালিত শাখা থেকে উনি প্রায় ৪৫ হাজার টাকার কৃষিঋণ নেন। তা এখন সুদে-আসলে ৫৯ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। তাঁর বাবা স্থানীয় সমবায় সমিতি থেকে ৩২ হাজার টাকা ধার নেন। সেই খাতেও সুদে-আসলে ৪৫ হাজার টাকা বাকি। দু’জনেই কোনও টাকা শোধ করেননি।”
বিকাশবাবুর বক্তব্য, একের পর এক লোকসানের ধাক্কায় ধার শোধ করার পরিস্থিতিই তাঁদের ছিল না। এখনও হিমঘরে পড়ে রয়েছে অন্তত ২৫ হাজার টাকার আলু। হিট্টা গ্রামের ঘোষপাড়ায় তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মরাইয়ে প্রচুর ধান জমে রয়েছে। মৃতের স্ত্রী মামনিদেবী বলেন, “আমার স্বামী প্রায় প্রতি দিনই ধান বিক্রির চেষ্টা করতেন আর হতাশ হয়ে ফিরতেন। সব মিলিয়ে দেড় লক্ষ টাকারও বেশি ঋণ ছিল।”
জেলাশাসকের দাবি, ধান বিক্রির জন্য সুশান্তবাবুকে চালকল থেকে নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় চাষিদের চালকলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আদৌ সুখকর নয়। গ্রামের কৃষ্ণ ঘোষের কথায়, “আমাদের কারও ধানই বিক্রি হয়নি। প্রতি দিনই ট্রাক্টর ভাড়া করে চালকলে গিয়ে দেখছি, আগে থেকে অন্তত ৫০টা ট্রাক-ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সারা দিন পরে যখন আমাদের সময় আসছে, চালকল বলছে, আর ধান কেনা সম্ভব নয়। ৬০ কেজির বস্তার সরকারি সহায়ক মূল্য যেখানে ৬৪৮ টাকা, ফড়েদের কাছে ৩৫০-৪০০ টাকায় তা বেচে দিতে হচ্ছে।”
চালকলে ধান দিতে পারলেই যে সব সমস্যার সমাধান, তা-ও নয়। হিট্টার চাষি ইন্দ্রজিৎ ঘোষের দাবি, “ধান কেনার পরে চালকলগুলি যে চেক দিতে চাইছে, তা অন্তত আড়াই মাস আগে ভাঙানো সম্ভব নয়। সারের দোকানদার, খেতমজুরেরা পাওনা বুঝে নিতে অত দিন অপেক্ষা করবে?” সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের বড়ঞা ও সাগরদিঘিতে চালকলের দেওয়া চেক ‘বাউন্স’ও করেছে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেন, “আগে কৃষকদের জন্য যে টাকা ধার্য থাকত, তার অর্ধেকটা দিয়ে ধান কিনত সিপিএমের ক্যাডাররা। বাকিটার অর্ধেক দিত দলকে, আর অর্ধেক নিজেরা নিত। আমি এসে চেকের ব্যবস্থা করায় এখন ওই কমরেডদের রাগ হচ্ছে। তাই সরকারের বিরোধিতা করছে।”
ধান ছাড়াও এ বার প্রায় পাঁচ বিঘে জমিতে আলু চাষ করেছিলেন সুশান্তবাবু। কিন্তু গত মরসুমে দাম না পাওয়ার পরে এ বার আবার গলসির বেশ কিছু এলাকায় সেচের জলের অভাব হয়েছে। স্থানীয় চাষি হারাধন ঘোষের আক্ষেপ, “গ্রামে অনেকেই খরিফ আর বোরো ধানের মাঝে ফাঁকা সময়টায় আলুচাষ করেন। কিন্তু এলাকার সমস্ত খেতেই এ বার জলের অভাবে গাছের বাড়বাড়ন্ত থমকে গিয়েছে।” সুশান্তবাবুর পরিবারের অভিযোগ, গাছ পুষ্ট না হওয়ায় অন্তত ৫০ হাজার টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছিলেন তিনি।
এ দিন হিট্টা গ্রামে ঘুরে এসে বর্ধমান-দুর্গাপুরের সিপিএম সাংসদ সাইদুল হক বলেন, “মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। কিন্তু চাষিদের সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে গায়ের জোরে ঘটনাগুলি অস্বীকার করা হচ্ছে। গত বছর খরার সময়ে আউশগ্রামে তিন চাষির আত্মহত্যার অভিযোগ ওঠায় তৃণমূলের কত নেতাই না ছুটে এসেছিলেন! এখন তাঁরা কোথায়?” যাদের ২০ বিঘা পর্যন্ত জমি আছে তাদের বিঘা পিছু ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে এ দিন দাবি করে রাজ্য বিজেপি-ও। কিন্তু এ নিয়ে বামেরা মুখ খোলায় উল্টে তাঁদেরই আক্রমণ করেছেন মমতা। তাঁর দাবি, “২০০৮-০৯ সালে রাজ্যে ১৭৯ জন এবং ২০০৯-১০ সালে ১৯৯ জন চাষি আত্মঘাতী হয়েছিলেন। ২০১০-২০১১ সালের কোনও তথ্য বামফ্রন্ট সরকার রেখে যায়নি। কৃষককে লুট করা, গরিবকে কোনও সম্মান না দেওয়া সিপিএম মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে রাখ।”
সারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে গত কিছু দিন ধরেই সরব বামপন্থীরা। মমতা পাল্টা বলেন, “২০১০ সালে সারের দাম বিনিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্র। তখন বামফ্রন্ট সরকার কেন আপত্তি জানায়নি?” সেই সময়ে রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা। সূর্যবাবুর টিপ্পনী, “ওঁরা আসলে গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব নীতি নিয়ে চলছেন! কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক হয়েও তখন কিছু বলেননি।” মমতা অবশ্য দাবি করেন, “সারের দাম যে বাড়ানো হচ্ছে তা আমি জানতাম না। সিপিএম কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে সারের দাম বাড়িয়েছিল।” তার পরেই তাঁর চ্যালেঞ্জ, “ক্ষমতায় আসার পরে আমি সারের দাম বাড়িয়েছি, এটা যদি প্রমাণ করতে পারেন, কালকেই আমি মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব!” |