ফের পর পর শিশুমৃত্যু মালদহ সদর হাসপাতালে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, সোমবার মাঝরাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত, ৩৬ ঘণ্টায় ১১টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, চলতি মাসে মালদহ হাসপাতালে এই নিয়ে ৪০ জন শিশুর মৃত্যু হল।
এগারোটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভ ছড়ায় হাসপাতালে। মৃত শিশুদের পরিবারের লোকজনেরা জানতে পারেন, হাসপাতালের সুপার, মালদহ মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ও ভাইস প্রিন্সিপ্যাল জেলার বাইরে রয়েছেন। তা নিয়ে হইচই শুরু হয়। মালদহের অতিরিক্ত জেলাশাসক নুরুল ইসলাম বলেন, “প্রশাসনকে না-জানিয়েই জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা বাইরে গিয়েছেন।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক স্বপনকুমার ঝরিয়াত অবশ্য জানান, সুপারের ছেলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় এক জনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে তিনি কলকাতা গিয়েছেন। মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সরকারি কাজে হায়দরাবাদে গিয়েছেন। ভাইস প্রিন্সিপ্যাল নীলরতন মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষা নিতে গিয়েছেন। |
মঙ্গলবারই বারুইপুরে সরকারি কলেজের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “এ রাজ্যে বছরে ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। আমরা এসে শিশুমৃত্যু ২ শতাংশ কমিয়েছি।” মালদহ মেডিক্যালে শিশুমৃত্যু কিন্তু থামছে না। ফলে প্রশ্ন উঠছে হাসপাতালের পরিকাঠামো এবং পরিষেবা নিয়ে। কলেজের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র বলেছেন, “সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) চালু করার পরেও কেন এত শিশুর মৃত্যু হল, বুঝতে পারছি না। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে রিপোর্ট চেয়েছি। যদি কারও গাফিলতি থাকে, তবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
যদিও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কারও গাফিলতি নেই বলে ইতিমধ্যেই দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “প্রতিটি শিশুই খুব সঙ্কটজনক অবস্থায় ছিল। এদের মধ্যে এক জনের জন্ম মালদহ হাসপাতালেই। বাকিরা অন্য হাসপাতাল থেকে এসেছিল। বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকেও দু’জনকে পাঠানো হয়েছিল। চিকিৎসকদের সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের বাঁচানো যায়নি।” তবু পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকার গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধায়কে বুধবারই মালদহে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীও জানিয়েছেন, তিনটি শিশুর ওজন ছিল অত্যন্ত কম, এক কেজি বা তার কাছাকাছি। দু’টি শিশুর ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া ছিল। এক জনের জন্ম থেকেই প্রবল শ্বাসকষ্ট ছিল। অন্য জনেরও ফুসফুসের সমস্যা ছিল। শিশু বিভাগে বেশ কয়েক জন চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকায় শিশুদের চিকিৎসা যথাযথ হয়নি বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা মানতে চাননি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী। |
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পর পর শিশুমৃত্যুর ঘটনার জেরে গত ১৬ ডিসেম্বর হাসপাতালে এসএনসিইউ চালু করা হয়। সেখানে ১৫টি শয্যা রয়েছে। সাধারণ শিশু বিভাগে রয়েছে ৯০টি শয্যা। এসএনসিইউ-এর জন্য ৪ জন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। সব মিলিয়ে হাসপাতালে ১২ জন শিশু বিশেষজ্ঞ আছেন।
তার পরেও শিশুমৃত্যু রোখা যাচ্ছে না কেন, তা খতিয়ে দেখতে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ টাস্ক ফোর্স আচমকা পরিদর্শনে গিয়ে চমকে যায়। পরিদর্শনকারীরা লিখিত রিপোর্টে জানান, এক শ্রেণির চিকিৎসক দায়িত্ব এড়াতে অপেক্ষাকৃত কম অসুস্থদের এসএনসিইউ-তে ভর্তি করাচ্ছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। যাতে গুরুতর অসুস্থ শিশুর জন্য শয্যা ফাঁকা না থাকে। কারণ, গুরুতর অসুস্থ শিশুকে এসএনসিইউ-এ ভর্তি করানো হলে বাড়তি নজর রাখতে হবে। চিকিৎসককে বেশি সময় দিতে হবে। এর পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দেয় স্বাস্থ্য দফতর। এমনকী, এসএনসিইউ-এ কাদের ভর্তি করানো হবে, তা আলাদা কমিটি গড়ে ঠিক করার সুপারিশ করেন পরিদর্শনকারীরা। ঘটনা হল, তার পরেও মালদহ হাসপাতালের হাল ফেরেনি। এসএনসিইউ-এ শিশু ভর্তি করাতে গিয়ে নাকাল হয়েছেন বলে অভিযোগ মৃত ৭টি শিশুর পরিবারের লোকজনের। বাকি ৪ জন অবশ্য এসএনসিইউ-এ ভর্তি করানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। মালদহ হাসপাতালের সুপার হিমাদ্রি আড়ি বলেন, “এসএনসিইউ-এ ভর্তির বিষয়টি শিশুরোগ বিভাগের প্রধান দেখেন। বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে যা বলার বলব। এটুকু বলতে পারি, শয্যা ফাঁকা থাকলে গুরুতর অসুস্থ শিশুকে ভর্তি করানো হবেই।”
|