|
|
|
|
রাজপুতানায় সন্ন্যাসী |
আইনের ফাঁসে
উপেক্ষিত স্মৃতির দুর্গ
গৌতম চক্রবর্তী • খেতড়ি (রাজস্থান) |
|
|
দিনটাকে সব সময় মনে রাখে খেতড়ি। বিবেকানন্দের জন্মদিন, ১২ জানুয়ারি সারা দেশে যুব দিবস। আর ১২ ডিসেম্বর তারিখটা ‘বীরাসত দিবস’ হিসেবে পালিত হয় এখানে।
বিবেকানন্দের জন্মভূমি কলকাতা শহরে এ রকম কোনও ‘বীরাসত দিবস’ নেই, থাকার কথাও নয়। শিকাগোয় বিবেকানন্দের সাফল্যের পর কলকাতায় একটি নাগরিক সম্মেলন হয়। স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেখানে পৌরোহিত্য করার অনুরোধ জানানো হয়। তিনি ‘টেকনিক্যাল’ প্রশ্ন তুলে অনুরোধ নাকচ করে দেন। কায়স্থের ছেলে সন্ন্যাসী হয় কী ভাবে? অবশেষে উত্তরপাড়ার প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় সভাপতিত্ব করেন। তিনিও অবশ্য মাঝামাঝি রাস্তা নিয়েছিলেন। সন্ন্যাসীকে তিনি স্বামী বিবেকানন্দ বলেননি, বলেছিলেন ‘ব্রাদার বিবেকানন্দ’। মাতৃভূমি কলকাতা শহরের বিদ্বজ্জন সমাজে বিবেকানন্দের জাতকুলগোত্র নিয়ে এই যে সংশয় তৈরি হয়েছিল, রাজপুতানার অজিত সিংহের রাজত্বে তা হয়নি।
বিবেকানন্দের স্মৃতিধন্য ‘ফতেহ বিলাস’ প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে কিছু দূর এগোলেই একটি দিঘিপান্না সায়র। সঙ্গে প্রশস্ত সিঁড়ি, রাজস্থানী ‘ছত্রী’ বা গম্বুজ। একপাশে সবুজ ময়দান। সেখানে হিন্দি ভাষায় ফলক। বিবেকানন্দ বিলেত-আমেরিকা থেকে ফেরার পর ১৮৯৭ সালের ১২ ডিসেম্বর এখানেই হয়েছিল বিরাট জলসা। ফলকের ভাষায়, ‘বিশাল রাজকীয় জলসা অউর প্রীতিভোজ হুয়ে।’ বিবেকানন্দের জন্মশতবর্ষে, ১৯৬৩ সালের ১২ ডিসেম্বর লাগানো হয়েছিল এই ফলক। গত বারেও জলসা আর আলোর রোশনাই হয়েছিল এই ময়দানে।
পান্না সায়রের চারপাশের ছত্রী আর রাজকীয় সৌধ গেরুয়া রঙে রঙিন। ‘ফতেহ বিলাস’ প্রাসাদের সংস্কার এবং প্রদর্শশালা তৈরির দায়িত্বে রয়েছেন সংরক্ষণবিদ বিক্রমজিৎ চক্রবর্তী। কলকাতার ছেলে বিক্রম এর আগে দিল্লির লালকেল্লা ও হুমায়ুনের কবর সংরক্ষণের স্থপতি ছিলেন। পান্না সায়রের গেরুয়া সৌধ দেখে উত্তেজিত তিনি, ‘রাজবাড়ির দিঘিতে কেন যে এই গেরুয়া রং!’ খেতড়ির রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী আত্মনিষ্ঠানন্দ জানালেন, তিনি ‘বীরাসত দিবস’ পালনের জন্য শহরের গণ্যমান্যদের নিয়ে ১৫ জনের একটি কমিটি করেছিলেন। তাঁদেরই এক জনের উৎসাহে এই দিঘির সংস্কার এবং গৈরিক বর্ণপ্রাপ্তি। ‘আপনারা বারণ করলেন না?’ বিক্রমের প্রশ্নের উত্তরে সন্ন্যাসী বলেন, ‘লোকাল সেন্টিমেন্ট সব সময় নাকচ করা যায় না।’ পান্না সায়র সংস্কার নিয়ে এই ‘অতি উৎসাহ’ই ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষে ‘হেরিটেজ’ শহর হওয়ার জন্য কতটা আকুুলিবিকুলি করতে পারে ১৭ হাজার বাসিন্দার খেতড়ি! |
|
ভোপালগড় কেল্লায় বিবেকানন্দের ঘর। ছবি: বিক্রমজিৎ চক্রবর্তী |
এই আকুলতার অন্যতম কারণ, ২৫ বছর ধরে আইনি জটে হাঁসফাঁস করা। রাজস্থানের বেশির ভাগ জায়গার ‘ব্র্যান্ড ইকুইটি’ সেখানকার দুর্গ। জোধপুর, জয়পুর, জৈসলমের বিকানের, চিতোর...উদাহরণ প্রচুর। খেতড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরেই আছে এখানকার রাজাদের ভোপালগড় কেল্লা। হাতির আক্রমণ রুখবার জন্য গজাল-সাঁটা লোহার দরজা, তোপখানা, ভিতরে বিশাল দরবার হল, একপাশে রানিদের মহল, তার ছাদে রাধাকৃষ্ণ এবং হরেক রঙিন ফ্রেস্কো আজও চোখ টানে। বিবেকানন্দ রাজার সঙ্গে দুর্গের একটি ঘরে দিন কয়েক ছিলেন। এখনও সেখানে ফায়ারপ্লেসের জায়গা অটুট।
‘হেরিটেজ ট্যুরিজম’-এর এই যুগে সেই দুর্গ রক্ষণাবেক্ষণের কেউ নেই। শেষ রাজা সর্দার সিংহর সন্তান ছিল না। ১৯৮৭ সালে মৃত্যুর আগে রাজকীয় বিষয়সম্পত্তি সামলানোর জন্য তিনি একটি ‘অছি পরিষদ’ তৈরি করে যান। রাজার বিষয় কে আগলাবে, তা নিয়ে আজও রাজস্থান সরকারের সঙ্গে সেই অছি পরিষদের মামলা চলছে। সর্দার সিংহের বাবা, রাজা অমর সিংহ ‘ফতেহ বিলাস’ প্রাসাদকে আরও বাড়িয়ে তাঁর প্রাসাদ ‘অমরমহল’ তৈরি করেছিলেন। সেই পরিত্যক্ত প্রাসাদও তালাবন্ধ। কিন্তু মামলার কারণে সে দিকে সংরক্ষণবিদেরা হাত দিতে পারবেন না। “সর্দার সিংহ আমাদের পথে বসিয়ে গিয়েছেন। যে অছি পরিষদ করে গিয়েছেন, তাতে খেতড়ির কেউ নেই। তার উপরে এই মামলা। এই মামলা না থাকলে সরকার বা রাজপরিবারের কেউ দুর্গ সংরক্ষণ করে ‘হেরিটেজ হোটেল’ করতে পারত, ট্যুরিস্ট আসত, আমাদেরও দুই পয়সা হত!” গত কয়েক দিনে খেতড়ির লোকদের মুখে বহু বার এই এক কথা শুনেছি।
দিল্লির শাহজাহানাবাদ এলাকার ‘কনজারভেশন আর্কিটেক্ট’ মোনালি ওয়াঙ্কারও খেতড়ি দুর্গের কথা বলছিলেন, “রানিমহলের ছাদে দেখেছেন রঙিন ফ্রেস্কো? ওটা চুরু, ঝুনঝুনু, বিসাউ এলাকার বৈশিষ্ট্য। শেখাবতী পেন্টিং।” তামার খনি, দুর্গ, বালিয়াড়ি, শেখাবতী পেন্টিং সব কিছু থেকেও নেই। এখন বিবেকানন্দ-ঐতিহ্যই এক এবং একমাত্র ভরসা।
খেতড়ি শহর থেকে ১০ কিলোমিটার এগোলে অজিতসাগর। রাজস্থান সরকারের ভূমি ও জলসেচ দফতরের আওতায় থাকা এই বাঁধের লকগেটে ফলক: ‘১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে এই বাঁধ উদ্বোধন করলেন জয়পুরের রেসিডেন্ট কর্নেল পিকক। রাজাসাহেবের দেওয়ান কানহাইয়ালালের তত্ত্বাবধানে ৮৬,৩৯৪ টাকায় তৈরি হল এই বাঁধ।’ এর আট মাস পরে অগস্টেই রাজা অজিত সিংহের সঙ্গে খেতড়ি আসবেন বিবেকানন্দ। এবং এখানে শিষ্যের সঙ্গে বেড়াতেও আসবেন। বাঁধের পাশে তিন তলা ‘হান্টিং লজ’। অজিত সিংহের আমলে এটি একতলা ছিল। সেই এক তলার ঘরে, কখনও বা জলের ধারে গিয়ে বসতেন বিবেকানন্দ। স্বামী আত্মনিষ্ঠানন্দ বললেন, “দুর্গটা রয়েছে। রাজাদের পুরনো পোলো গ্রাউন্ড, আস্তাবলও সবাই দেখতে পাচ্ছে। তার পাশে ফতেহ বিলাস, পান্নাসর তালাও আর অজিতসাগর নিয়ে ‘হেরিটেজ ওয়াক’ চালু করা গেলে পর্যটকরা আসতেন। এখানকার লোকেরও কিছু আর্থিক সুরাহা হত।”
খেতড়ি এখন সেই ঐতিহ্যময় হাঁটাপথের অপেক্ষায়!
|
(চলবে) |
|
|
|
|
|