ঘিঞ্জি এলাকায় স্কুল-হাসপাতাল বা বহুতলের পাশে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থান তো রয়েইছে, ন্যূনতম সচেতনতারও ‘পরোয়া’ নেই। রাতের পেট্রোল পাম্প তাই হামেশাই ঠাসাঠাসি গাড়ির ভিড়ে হয়ে ওঠে মহানগরের ‘ব্যস্ত পার্কিং লট’। সেগুলি গাড়ি সারাইয়ের ওয়ার্কশপ, না পেট্রোল পাম্প শহরের পোড়খাওয়া নাগরিকদেরও মাঝেমধ্যেই এমন ধন্দে পড়তে হয়।
ক্যামাক স্ট্রিটে পেট্রোল পাম্পের আগুনে বড় ‘বিপর্যয়’ থেকে কলকাতা রক্ষা পেলেও ঘনবসতি এলাকায় বিপজ্জনক পেট্রোল পাম্পের বিষয়ে কারও ‘হুঁশ’ ফেরার লক্ষণ নেই। প্রশাসন, কেন্দ্রীয় বিস্ফোরক নিয়ন্ত্রক বিভাগ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই যেন ‘দায়’ এড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
অথচ, মাসখানেক আগে আমরি-কাণ্ডের পরেই এ রাজ্যে পেট্রোল পাম্পগুলির বিপদের ঝুঁকি কতটা, তা খতিয়ে দেখতে তেল সংস্থাগুলিকে চিঠি লিখেছিলেন পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরা। এ বার ক্যামাক স্ট্রিটের পেট্রোল পাম্পে সেই বিপদের ভয়াবহতা হাতে-কলমে কিছুটা পরখ করার পরে কিন্তু সেই পারস্পরিক দোষারোপই শুরু হয়েছে। |
কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম আইন অনুযায়ী, সতর্কতামূলক যে ব্যবস্থাগুলি মেনে চলার কথা, তা অবশ্য এ শহরে কার্যত শিকেয় বলে মানছেন বিস্ফোরক নিয়ন্ত্রক বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা। বছরে অন্তত এক বার পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও বাস্তবে এক-একটি পেট্রোল পাম্পে এক বার ঢুঁ মারতে বিশেষজ্ঞদের অন্তত চার-পাঁচ বছর লেগে যায়। পূর্বাঞ্চলের যুগ্ম চিফ এক্সপ্লোসিভ কন্ট্রোলার দেবজ্যোতিষ রায়ের কথায়, “পূর্ব ভারত ও উত্তর-পূর্বের ১৩টি রাজ্যের জন্য প্রধানত পাঁচ জন অফিসার আছেন। পেট্রোল পাম্প, গ্যাস সিলিন্ডার, এলপিজি ব্যাঙ্ক, বিস্ফোরক কারখানা মিলিয়ে ৩৩-৩৪ হাজার লাইসেন্স পরীক্ষার দায়িত্ব এই ক’জনের ঘাড়ে। ফলে কাজের বোঝা কখনওই হাল্কা হয় না।”
কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী, স্কুল-হাসপাতালের কাছে পেট্রোল পাম্প বসানো নিয়ে নিষেধাজ্ঞা তো রয়েইছে, ট্যাঙ্ক থেকে পাম্পে তেল সরবরাহ, পাম্প থেকে গাড়িতে তেল ভরা বা গ্যাস বেরোনোর ‘ভেন্ট-পাইপ’ ঘিরে বেশ কিছুটা জায়গা খালি রাখার নিয়ম। সাড়ে তিন থেকে ছ’মিটারের ব্যাসার্ধে ‘বিপজ্জনক অঞ্চল’ বলে চিহ্নিত ওই এলাকাটুকু নিরাপত্তার স্বার্থে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়ার কথা। বাস্তবে, অবশ্য শহরে এমন পেট্রোল পাম্প বিরল। কলকাতার পুরনো বাড়িগুলিতে আগুনের মোকাবিলায় সুরক্ষার খামতি নিয়ে প্রশাসনের কর্তারা যা বলে থাকেন, বিপজ্জনক পেট্রোল পাম্পগুলি নিয়েও তাঁরা একই কথা বলছেন।
কলকাতার এক পুরকর্তার কথায়, “আইন পরে হয়েছে, শহরের পেট্রোল পাম্পগুলি তার চেয়ে ঢের পুরনো। ফলে কিছু সমস্যা থেকেই গিয়েছে।” বিস্ফোরক নিয়ন্ত্রক দফতর থেকে শুরু করে বিভিন্ন তেল সংস্থারও অভিযোগ, ওই ‘নিষিদ্ধ’ অঞ্চলটুকুতেই কোনও কোনও পাম্প-মালিক গাড়ির পার্কিং লট তৈরি করেন। কিংবা বিপজ্জনক ভাবে পেট্রোল পাম্পের পাশেই গাড়ি সার্ভিসিংয়ের ব্যবস্থা থাকে।
এই ‘বেনিয়মে’র দৃষ্টান্ত ক্যামাক স্ট্রিটের পেট্রোল পাম্পেও। দমকলের এক কর্তার অভিযোগ, “গাড়ি সারাইয়ের ব্যবস্থা না-থাকলে ক্যামাক স্ট্রিটের পাম্পে কোনও অঘটন ঘটত না। দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়িতে আগুন ধরে। তার পরে ওই চত্বরে পড়ে-থাকা মোবিল জাতীয় পদার্থ থেকে আগুন হুহু করে ছড়িয়ে পড়ে।” বিস্ফোরক-বিশেষজ্ঞ দেবজ্যোতিষবাবু বা ইন্ডিয়ান অয়েলের মুখপাত্র অলোক কুমারও বলছেন, প্রযুক্তিগত ত্রুটির থেকেও লোকের ভিড়েই পেট্রোল পাম্পে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।”
দেবজ্যোতিষবাবু বলেন, “পেট্রোল পাম্প চত্বরে কোনও দাহ্য পদার্থ থাকার কথা নয়। কোনও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও অগ্নি-নিরোধক পদার্থে সুরক্ষিত রাখার কথা। কিন্তু অনেক উটকো লোকে পাম্পে ঢুকে ধূমপান করেন। তা ছাড়া, গাড়ির অযথা ভিড় থেকেও সমস্যা বাড়ে।” বাস্তবিক, শহরের ব্যস্ত এলাকায় প্রতি রাতেই পেট্রোল পাম্পগুলি সবার চোখের সামনে বাস-ট্যাক্সির ‘গ্যারাজ’ হয়ে ওঠে।
পেট্রোলিয়াম ডিলারদের সংগঠনের সভাপতি তুষারকান্তি সেন কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, “এ ভাবে গাড়ির সার্ভিসিং ও পেট্রোল পাম্পের কারবার পুলিশ-প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই হয়ে থাকে।” তেল সংস্থাগুলির প্রতি তোপ দেগেই তুষারবাবু বলছেন, “তেল সংস্থাগুলি আমাদের পাম্পের ট্যাঙ্কে বাড়তি তেল ভরতে বাধ্য করে। এর থেকেও বিপদ হতে পারে।” তাঁর কথায়, “তেল সংস্থাগুলিকে বারবার পাম্পকর্মীদের আগুন নেভানোর তালিম বা বিপদের মোকাবিলায় পরামর্শ দিতে বলেছি। লাভ হয়নি। পাম্পের জন্য জলাধার গড়ে দেওয়া নিয়ে কথা বলেও লাভ হয়নি।” ইন্ডিয়ান অয়েলের মুখপাত্র অলোক কুমার বা ভারত পেট্রোলিয়ামের টেরিটোরিয়াল ম্যানেজার শুভঙ্কর সেনের অবশ্য বক্তব্য, নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনেই দফায় দফায় পেট্রোল পাম্পগুলির উপরে নজর রাখা হয়।
শহরের প্রশাসনিক কর্তারা কেউই অবশ্য পেট্রোল পাম্প বিভ্রাটের দায় নিজের ঘাড়ে নিতে রাজি নন। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পুরসভা আর কত দিক দেখবে? যাঁরা নিজেরা দাহ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, তাঁদের কি সব সময়ে লাঠি দিয়ে সচেতন করা সম্ভব?” |