করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে পরপর দু’টি ঘটনায় হাসপাতালের দু’জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল। মঙ্গলবার বিকেলে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে তদন্তে আসেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অমিত হালদার ও ডেপুটি সিএমওএইচ দিব্যেন্দু চক্রবর্তী। হাসপাতালের সুপার, অভিযুক্ত ওই দুই চিকিৎসক ও হাসপাতালের অন্য চিকিৎসক ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের নিয়ে তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অমিত হালদার বলেন, ‘‘প্রত্যেককে নিয়ে আলাদা আলাদা করে বসে আলোচনা করা হয়েছে। জানার চেষ্টা করেছি সমস্যাটা ঠিক কোথায়। সকলকে বলা হয়েছে সকলের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলতে। বলা হয়েছে আরও বেশি মানবিক হতে। এছাড়া যে দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেই বিষয়েও আমরা তদন্ত শুরু করেছি। সেই তদন্তে তাঁদের দোষ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, শুধু রোগ নিরাময় নয়, চিকিৎসকদের কাছ থেকে রোগীরা চায় ভাল ব্যবহারও। করিমপুর পান্নাদেবী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রবোধকুমার সাহা বলেন, ‘‘একটা সময় ছিল যখন চিকিৎসকের মুখ থেকে দু’একটি কথা শুনলেই যেন অর্ধেক রোগ ভাল হয়ে যেত। আসলে ব্যবহার ভাল হলে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে দূরত্ব কমে। সে ক্ষেত্রে রোগীরা চিকিৎসককে সহজে সব কথা বলতে পারেন, চিকিৎসকও সহজ হয়ে যান।’’
চিকিৎসকরা কী বলছেন? করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের এক চিকিৎসক রাজীব ঘোষ বলেন, ‘‘আমরাও কিন্তু সবসময় ভাল পরিষেবা দিতে চাই এবং যতটা সম্ভব সেটা দিচ্ছিও। কিন্তু আমাদেরও কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সেটাও কিন্তু সকলকে বোঝার দরকার।’’ রাজীববাবু বলেন, ‘‘খাতায় কলমে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের উপর প্রায় দু’লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। কিন্তু বাস্তবে সেই সংখ্যাটা পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। এ দিকে হাসপাতালে চিকিৎসক কম। তার মধ্যেও তো কেউ ছুটি নেবেন, কেউ প্রশিক্ষণে যাবেন। অতএব এখন পাঁচ জনকেই হাসপাতালের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাই কোনও চিকিৎসক নাইট ডিউটি করে ফের সকালে আউটডোর সামলাচ্ছেন, আবার তাঁকেই ফের নাইট ডিউটি করতে হবে।” তাঁদের কথায়, এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ লেগেই রয়েছে। তিনি বলেন, “চিকিৎসকেরাও যে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন পরিষেবা দেওয়ার, এটাও কিন্তু সকলেরই বোঝা উচিত।’’
হাসপাতালের আর একজন চিকিৎসক ঐন্দ্রিলা বসু বলেন, ‘‘এই হাসপাতালে সারা বছরই রোগীদের চাপ থাকে। এদিকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসক থাকেন একজন। ফলে জরুরি বিভাগ, প্রসূতি বিভাগ, পুরুষ ও মহিলা বিভাগ তাঁকে একাই সামলাতে হয়। তাছাড়া প্রতিনিয়ত হাসপাতালে রোগী আসছে। সেই অবস্থায় আমাদেরই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কোন রোগীর সমস্যা কত বেশি। সেই মতো আমাদের চিকিৎসা করতে হয়। তুলনামূলক ভাবে কম অসুস্থ রোগীকে তাই অপেক্ষা করতে হলে তিনি চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলবেন, এটা কিন্তু ঠিক নয়।’’
এ ছাড়াও রয়েছে কিছু অন্য সমস্যা। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমস্যা হয়, ঘটনা ঘটার অনেকক্ষণ পরে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সর্পদষ্ট রোগীর ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা বেশি। অনেক সময়েই ওই রোগীকে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মৃতপ্রায় সেই রোগীকে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, বহু চেষ্টা করেও তাঁকে বাঁচাতে না পারলে রোগীর বাড়ির লোকজনও কিন্তু দোষ দেন চিকিৎসককেই।
করিমপুর রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি তথা স্থানীয় বিধায়ক সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ অবশ্য বলেন, ‘‘সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এসব কিছু জেনেই তো চিকিৎসকরা এই পেশায় এসেছেন।” রোগীর পক্ষে চিকিৎসা শাস্ত্র বোঝা সম্ভব নয়। তাই সে ভুল করে। সমরেন্দ্রবাবু বলেন, “সব পেশাতেই কিছু না কিছু সমস্যা থাকবেই। সেগুলোকে কাটিয়ে নিজের কাজটা ঠিক মতো করে যাওয়াটাই তো আসল ব্যাপার। হাসপাতালে অনেক কিছুরই ঘাটতি আছে, অনেক কিছুর সরবরাহ বন্ধ। কিন্তু চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসকদের আরও একটু মানবিক হওয়ার জন্য সদিচ্ছা ছাড়া আর কিছুর দরকার হয় না। সেটুকু করলেও তো অনেকটাই করা হয়।’’ |