সরকারেরই মুখ চেয়ে চাষিরা
ধানের পর আশঙ্কা আলুতেও
ধানের ন্যায্য-মূল্য তো মিলছেই না। এ বার আলু-চাষেও ক্ষতির আশঙ্কায় পশ্চিম মেদিনীপুরের চাষিরা। এখনই ২১০ টাকা কুইন্টাল দরে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে। চাষির কথায়, কুইন্টাল প্রতি এখনই লোকসানের বহর কমপক্ষে ১২৫-১৫০ টাকা। সহায়কমূল্যে সরকার প্রতিশ্রুতি মতো ধান কিনতে না-পারলেও সেই সরকারের কাছেই চাষির দাবি, সরকারি উদ্যোগে আলু কেনা হোক। তাঁদের বক্তব্য, সরকারি উদ্যোগে আলু কেনা শুরু হলে অন্তত বাজারে আলুর দাম পড়বে না। সেখানে অন্তত লোকসান কমবে।
জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার জমি থেকে ফেব্রুয়ারি নাগাদ আলু তোলা শুরু হবে। সামান্য কিছু এলাকায় এখনই খেত থেকে কিছু তোলা আলু তোলা হচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে গড়ে ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। এ বার অবশ্য ৬৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। সাম্প্রতিক বৃষ্টি-কুয়াশার জেরে ৪৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল আংশিক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষি দফতরই। ফলে, এক ধাক্কায় উৎপাদন অনেকটাই কমার আশঙ্কা।
কৃষি দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “২৪-২৫ লক্ষ টন আলু উৎপাদনের আশা থাকলেও এখন তা কমে ১৪-১৫ লক্ষ টনে নেমে আসতে পারে।” এ জেলায় গড়বেতাই আলুর গোলা। বেশির ভাগ আলুই চাষ হয় গড়বেতায়। গড়বেতা-৩ ব্লকের সারবেড়্যায় বাড়ি ধীরেন মান্ডির। এ বার ৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। তাঁর কথায়, “চাষের খরচ বেড়েই চলেছে। কিন্তু বাজারে ফসলের দাম বাড়ছে না। স্টোরে মজুত করা গত বছরের আলু কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। তাই বাজারে দাম না-থাকলে এ বার ক্ষতির মুখ দেখতে হবে।” স্থানীয় খগেন মাহাতো-র কথায়, “আলুর দাম কী হবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। বৃষ্টির জন্য এ বার উৎপাদন কম হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তবে, এখনই তো ২১০ টাকা কুইন্টাল দরে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে!” তাঁর কথায়, “এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতেই ১০ হাজার টাকা খরচ পড়ে যায়। অথচ, একই পরিমাণ জমির ফসল বেচে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা আসে।” এই এলাকারই চাষি বিজয় মান্ডি বলেন, “কেউই নিজের জমি ফেলে রাখতে চায় না। তাই ক্ষতি মেনেই চাষ করতে হয়। চাষিরা তো নিজেদের মজুরি হিসেবে ধরে না। ধরলে চাষে লাভ খুঁজে পাওয়াই যাবে না।” তবে এ বার বীজের দাম তুলনায় কম ছিল বলে জানাচ্ছেন চাষিরা। তাঁদের বক্তব্য, এক বিঘা জমিতে ৪ বস্তা বীজ লাগে। এক সময়ে বীজের দাম অত্যন্ত বেশি ছিল। এ বার অবশ্য কিছু কম দামে বীজ পাওয়া গিয়েছিল।
শালবনি ব্লকের কাছারি রোডে বাড়ি অসিত মাইতি-র। মঙ্গলবার দুপুরে এক প্রতিবেশীর জমির আগাছা পরিষ্কার করছিলেন। নিজের প্রায় ১৩ কাঠা জমি রয়েছে। আগে থেকে চাষ শুরু করেছিলেন। এক মাস আগেই নিজের জমির ফসল বিক্রি করেছেন। তাঁর কথায়, “পোখরাজ আলুর চাষ করেছিলাম। বিক্রি করে কুইন্টাল-পিছু ৪০০ টাকা করে পেয়েছি। তবে এখন দাম প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।” তাঁর কথায়, “চাষ শুরুর ৬২ দিনের মাথায় ফসল তুলে বিক্রি করেছি বলেই ওই দাম পেয়েছি। না-হলে পেতাম না।” স্থানীয় ফকির হাঁসদা-র কথায়, “সরকার যদি সহায়কমূল্যে আলু কেনে, তা হলেই একমাত্র রক্ষা পাওয়া সম্ভব। না-হলে কম দামেই বিক্রি করতে হবে। ধানেও দাম পাইনি। আলুতেও মার খেলে কী ভাবে বাঁচব!” এ বার আমন ধানের চাষে ক্ষতির মুখ দেখতে হয়েছে বলে দাবি জেলার অধিকাংশ চাষিরই। জেলায় সাধারণত, ৪ লক্ষ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। এ বার ৫ লক্ষ ৩২৭ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। কিন্তু, সহায়কমূল্যে ধান কেনায় সে ভাবে গতি নেই। যেখানে জেলায় সহায়কমূল্যে ধান কেনার ক্ষেত্রে সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য ১ লক্ষ ৮০ হাজার টন, সেখানে দু’মাসে কেনা হয়েছে মাত্রই ৫২ হাজার টন। ফলে খোলাবাজারেও ক্রমান্বয়ে পড়ছে ধানের দাম। এই পরিস্থিতিতে সরকারকেই ‘সক্রিয়’ হওয়ার দাবি জানাচ্ছে কৃষক সংগঠনগুলি। সিপিএমের কৃষক সংগঠন ‘সারা ভারত কৃষকসভা’র জেলা সম্পাদক হরেকৃষ্ণ সামন্ত বলেন, “বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও সব ধান সরকারি উদ্যোগে কেনা হয়েছে, তেমনটা নয়। কিন্তু, সহায়কমূল্যে ব্যাপক ভাবে ধান কেনার ফলে খোলাবাজারে ধানের দাম সে ভাবে পড়ত না।” তাঁর কথায়, “অনেকেই কম দামে আমন ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। চাষে ক্ষতি এড়াতে এখন সরকারেরই উচিত ইতিবাচক পদক্ষেপ করা।”
সঙ্কটে চাষাবাদ
ধান আলু
আমনের উৎপাদন এ বার উৎপাদন
• ১৯ লক্ষ ১ হাজার ২৪২ টন
(চাষ ৫ লক্ষ ৩২৭ হেক্টর জমিতে)।
• ২৪-২৫ লক্ষ টন প্রত্যাশিত হলেও আচমকা বৃষ্টি-কুয়াশা এবং তৎপরবর্তী ধসা রোগের কারণে উৎপাদন ১৫ লক্ষ টনে নেমে আসতে পারে (চাষ হয়েছে ৬৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে)।
গতবার উৎপাদন: প্রায় সাড়ে
১৭ লক্ষ টন
গতবার উৎপাদন: ২৭ লক্ষ ৯২ হাজার ১৭৩ টন
এ বার বাজারে দর ২১০ টাকা/কুইন্টাল
সহায়কমূল্যে কেনা: নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এখনও পর্যন্ত কেনা হয়েছে মাত্র ৫২ হাজার ৭৪৩ টন। (ঘোষিত লক্ষ্য ১ লক্ষ ৮০ হাজার টন) গতবারের দর: ২৬০ টাকা/কুইন্টাল
খোলাবাজারে দাম: ৮২০ টাকা/কুইন্টাল
(সহায়কমূল্য ১০৮০ টাকা/কুইন্টাল)
(গতবার খোলাবাজারে দাম ৯০০ টাকা/কুইন্টাল)
গতবারের আলু পড়ে: ১ কোটি ১২ লক্ষ ৫২ হাজার ১১৭ কুইন্টাল (=১১ লক্ষ টনের বেশি) হিমঘরে মজুত আলুর
অর্ধেকই পড়ে (১০০ কুইন্টাল বা ১০ মেট্রিক টন আলু
হিমঘরে রাখতে খরচ ১০-১১ হাজার টাকা।
পা্যকেজিং-পরিবহণ খরচ বাবদ আরও সাড়ে ৬ হাজার
টাকার ধাক্কা। পরিস্থিতি এমন ২০ টন আলু হিমঘরে
রেখে বিক্রি করতে হচ্ছে ৪ হাজার টাকায়)।
কত ধান পড়ে: সঙ্কটে অভাবি বিক্রি বাড়ছে। উৎপাদনের ৬০-৭০ শতাংশই কম দামে (এমনকী ৭০০ টাকা/কুইন্টাল দরেও) বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন চাষি। পড়ে রয়েছে বাকি ৩০ শতাংশ ধান। এই মুহূর্তে দাবি: ৩৫০-৪০০ টাকা/কুইন্টাল
দরে সরকার আলু কিনুক,
তবেই বাজার চাঙ্গা হবে।
এই মুহূর্তে দাবি: শুরু থেকেই সহায়কমূল্যে ধান কেনায় গতি থাকা জরুরি ছিল। তবেই
বাজারেও দাম বাড়ত। সহায়কমূল্য হওয়া উচিত ছিল অন্তত ১৩০০ টাকা/কুইন্টাল।
বীজ-সার-মজুরি-সহ চাষের খরচ লাফিয়ে বাড়ছে, সহায়কমূল্য
সে তুলনায় বাড়েনি বলেই অভিযোগ।

সিপিআইয়ের কৃষক সংগঠন ‘সারা ভারত কৃষকসভা’র জেলা সম্পাদক বিমল ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, “এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত ৭ টাকা কেজি দরে আলু কেনা।” এসইউসিআইয়ের কৃষক সংগঠন ‘আলু-চাষি সংগ্রাম কমিটি’র রাজ্য সহ-সম্পাদক প্রভঞ্জন জানাও বলেন, “গত বছর যাঁরা হিমঘরে আলু রেখেছিলেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নামমাত্র দামে এখন আলু বিক্রি করছেন। সারা রাজ্যে ২০ লক্ষ আলু চাষি রয়েছেন। সব মিলিয়ে ১ কোটি মানুষ এই চাষের সঙ্গে যুক্ত। এই পরিস্থিতিতে সরকারি উদ্যোগে ৮ টাকা কেজি দরে আলু কেনা উচিত।” তৃণমূলের কৃষক নেতা অজিত মাইতি-র অবশ্য দাবি, রাজ্য সরকার কৃষকদের পাশেই রয়েছে। তাঁর কথায়, “সহায়কমূল্যে ধান কেনার ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা একাংশ চালকলের জন্যই। তারাই তৎপর হচ্ছে না।” তাঁর বক্তব্য, “আলু চাষিরা যাতে ক্ষতির মুখে না-পড়েন সে জন্য সরকার নিশ্চিত ভাবেই পদক্ষেপ করবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.