মোমিনপুর রোডে চার মাথার মোড় ছাড়িয়ে বড় জোর কয়েক হাত দূরে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের পাশে দু’জন বসে। বয়স মেরেকেটে পঁচিশ। এক জনের পরনে লুঙ্গি, জামার উপরে কালো ফুলহাতা সোয়েটার। অন্য জনের পরনে প্যান্ট আর জামার উপরে জ্যাকেট।
“দাদা, এখানে পাতা পাওয়া যায়?” ভাল করে দেখে নিয়ে দুই যুবকের জবাব, “ক’টা লাগবে?” প্রতি পাতার কত দাম? সংক্ষিপ্ত উত্তর, “একশো।” কিন্তু বন্ধুরা তো পঞ্চাশ-ষাট টাকায় নিয়ে যায়! এ বার সাফ জবাব, “এখন মালের টান আছে। একশোর নীচে দিতে পারব না। কিনতে হয় ৭০-৮০ টাকায়। কেনা দামে দিলে লাভ থাকবে না।”
লুঙ্গি পরা যুবক যেচেই বলল, “ভাল বাড়ির মেয়ে, এ সব খান কেন?” তার পরেই ফের জেরা, “কী করেন? কোথায় থাকেন?” ডাক্তারি পড়ি, কলেজের হস্টেলের বন্ধুদের হয়ে কিনতে এসেছি শুনে এ বার প্রশ্ন, “ক’টা লাগবে?” একটা পাতা লাগবে, দরকারে রাতেও আসতে হতে পারে শুনে এ বার টাকার জন্য এগিয়ে এল হাত। একশো টাকা বার করে দিতেই নিমেষে হাওয়া যুবক। খানিক পরে উঠে গেল সঙ্গীও। এ বার কী করা উচিত ভাবতে ভাবতেই পিছন থেকে ডাক, “দিদি সঙ্গে আসুন।” পিছনে যেতে যেতে অস্বস্তিটা বাড়ছিল। অগত্যা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই যুবককে বলতেই হল, “এখানেই দাঁড়াচ্ছি, আপনি নিয়ে আসুন।”
দশ মিনিট পার। পনেরো মিনিট। আধ ঘণ্টা পরেও কারও দেখা নেই। অগত্যা ওই রাস্তা ধরে এগোতেই এলাকার ‘সোর্সে’র মুখোমুখি। ‘খবর’ এল, ড্রাগ বিক্রেতা ফিরছে। পাশ দিয়ে যেতে যেতে এ বার যুবক হাতে গুঁজে দিল এক টুকরো কাগজ। পরে এলে কোথায় পাওয়া যাবে? চুপচাপ পিছনে পিছনে যাওয়ার নির্দেশ মিলল। এ বার নির্ভয়েই পিছু নেওয়া গেল। পিছনেই আসছেন ‘সোর্স’ও। |
হাঁটতে হাঁটতে ফের আগের জায়গায়। সেখান থেকে গলিতে পিছু পিছু চলা। নাম কী? “ইসরায়েল।” খানিকটা সাবধান হয়েই এ বার ইসরাইল জানিয়ে রাখল, কেউ পরিচয় জানতে চাইলে বলতে হবে ‘বন্ধু’। গলির ভিতরে একটা বাঁক নিয়ে পরের বাঁকের মুখে বড় কাঠের দরজা। ইসরাইল বলল, “এটাই আমার বাড়ি। যদি বাইরে চায়ের দোকানে না পান, শুধু মনে রাখবেন, এটা পেঁয়াজ গলি। সোজা এখানে চলে এসে দরজায় টোকা দিয়ে ইসরাইল বা আক্রাম নাম ধরে ডাকবেন। আমাকে পেয়ে যাবেন।”
খবর ছিল, একবালপুর থানা এলাকার ইব্রাহিম রোড, একবালপুর লেন (কদমতলা), মোমিনপুরের পেঁয়াজ গলি, চাল গলি, দোপাট্টা গলি, গুল গলি, বরফ গলি, শাহআমা লেন, ময়ূরভঞ্জ রোড সর্বত্রই প্রকাশ্যে মেলে মাদক। বসতি এলাকায়, বাজারের মধ্যে বিভিন্ন মোড়ে মোড়েই রয়েছে মাদক বিক্রেতারা। শুধু কার কাছে নেশার সামগ্রী মিলবে, একটু জেনে নিলেই হল। জানা গেল, সম্প্রতি এলাকায় পুলিশের উপরমহল থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে মিটিং হয়েছে, কী করে মাদক ব্যবসার রমরমা বন্ধ করা যায়। হয়েছে এক রাজনৈতিক দলের মাদক-বিরোধী মিছিল, যাতে স্থানীয় বিধায়ক ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও ছিলেন। তার পরেও জমিয়ে চলছে মাদকের ব্যবসা।
পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “ওই এলাকায় রিকশাচালক থেকে চায়ের দোকানি সকলের কাছেই মাদক মেলে। প্রশাসন প্রায়ই অভিযান চালায়। কিন্তু কত জনকে পুলিশ গ্রেফতার করবে? দরকার জন-সচেতনতা। এক দিন মিছিল করলেই এই ব্যবসা বন্ধ হবে না। তাই নিয়মিত মিছিল-মিটিং বা ক্যাম্প করে মানুষকে সচেতন করব আমরা।”
ওই এলাকায় সকাল থেকেই যে মাদক সহজলভ্য, তা স্বীকার করলেন নারকোটিক্স বিভাগের এক পদস্থ অফিসার। বললেন, “একবালপুর থানার ওই এলাকায় মাদকের রমরমার খবর আমাদের কাছেও আছে। মোমিনপুর বাজার সংলগ্ন এলাকায় বহু বার মাদক বিক্রেতাদের ধরলেও তারা খুচরো ব্যবসায়ী বলে জামিনযোগ্য কেস হয়। নারকোটিক্স বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, বড় মাত্রায় মাদক-সহ কেউ ধরা না পড়লে জামিন-অযোগ্য কেস দেওয়া যায় না। তবে আমাদের কাছে খবর, ওই এলাকায় পুরুষদের থেকে মহিলারাই ব্যবসায় বেশি যুক্ত। তাদের কাছ থেকে এই খুচরো ব্যবসায়ীরা মাদক এনে বিক্রি করছে। বড় চাঁইদের নাম পেয়েছি। আমাদের দফতর থেকে বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে।” সেই সঙ্গে স্থানীয় থানার এত কাছে মাদকের রমরমা কী করে চলছে এবং থানা কোনও বাবস্থা নিচ্ছে না কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
একবালপুর থানার অফিসার ইন-চার্জ মুন্সি আবদুল আহট অবশ্য ওই এলাকাকে মাদকের রমরমা বাজার বলতে একেবারেই রাজি নন। তিনি বলেন “এলাকার বেশ কিছু মাদকাসক্ত লোক মেটিয়াবুরুজ, তপসিয়া, ঠাকুরপুকুরের মতো বিভিন্ন এলাকা থেকে পুরিয়া কিনে আনে। সেখান থেকে নিজেরা হয়তো একটা খেল, বাকি এক-দু’টো অন্য কাউকে বিক্রি করল। এ ভাবেই চলতে থাকে। আমরা খবর পেলেই অভিযান চালাই, গ্রেফতারও করি।” |