ডাঁই করে রাখা ফাইলের স্তূপ প্রায় সিলিং ছুঁয়ে গিয়েছে। সেই স্তূপের আড়ালে কার্যত ঢাকা পড়ে গিয়েছেন অফিসের কর্মীরাই। অফিসে ঢুকতে গেলে অবশ্য বরাদ্দ ফাইলের গুঁতো। মেঝেতে পড়ে থাকা স্তূপীকৃত ফাইলের জন্য অফিসে বেঞ্চ পাতার জায়গাও কার্যত নেই। এমনকী, ফাইলের ‘পাহাড়ের’ চাপে অফিসের মেঝে বসে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ।
এ সমস্ত ফাইল বিয়ের রেজিস্ট্রির নথিপত্র। কিরণশঙ্কর রায় রোডে পঞ্চায়েত ভবনের তিনতলায় রাজ্য সরকারের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ম্যারেজের অফিসের রেকর্ড রুমের হাল এমনটাই। এক দিকে যখন বিয়ের বৈধকরণে জোর দিচ্ছে সরকার, তখন রেকর্ড রুমের ভিতরে এ ভাবেই হেলায় পড়ে অসংখ্য মানুষের বিয়ের আইনি প্রক্রিয়া সংক্রান্ত জরুরি কাগজপত্র।
ডাঁই করা কাগজপত্র ও কার্ডবোর্ডের মতো দাহ্য পদার্থে ঠাসা রেকর্ড রুমে কোনও কারণে আগুন লাগলে মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে শেষ হয়ে যেতে পারে সমস্ত নথিপত্র। অফিসের মূল দরজা বাদে যে একটি আপৎকালীন দরজা রয়েছে, সেটিও স্তূপাকার ফাইলের ‘চাপে’ কার্যত বন্ধ। |
এ ভাবেই জমছে নথির পাহাড়। ছবি: রাজীব বসু |
ফলে, কোনও বিপদ ঘটলে বেরোতে গিয়েও সমস্যায় পড়বেন কর্মীরা।
ওই অফিসে পাঁচটি রেকর্ড রুমে ১৮৮৬ সাল থেকে সমস্ত বৈধ বিয়ের নথিপত্র রয়েছে। কর্মীরা জানালেন, ব্রিটিশ আমলের খ্রিস্টান ম্যারেজ অ্যাক্টের নথিপত্রও রয়েছে তাঁদের দফতরে। কিন্তু ফাইলের উপরে ফাইল জমে এখন এমন অবস্থা যে, প্রয়োজনে কোনও নথি খুঁজে পাওয়াটাই দুষ্কর। অভিযোগ, সাধারণ মানুষের বিয়ের রেজিস্ট্রির নথির সঙ্গেই রয়েছে বহু বিখ্যাত মানুষের বিয়ের রেজিস্ট্রির কাগজপত্রও। সেগুলোও অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।
অথচ, বিয়ের রেজিস্ট্রির কাগজ হারিয়ে গেলে তার প্রতিলিপি নেওয়া থেকে শুরু করে নানা কারণে রোজই মানুষকে যেতে হয় ওই অফিসে। যেতে হয় এ রাজ্যের সব ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকেও। কারণ, তাঁরা যে সব বিয়ে দেন, তার রেজিস্ট্রির এক কপি এই অফিসে জমা দিতে হয়।
বিয়ের সার্টিফিকেটের ডুপ্লিকেট নিতে এসে রীতিমতো নাজেহাল হতে হয়েছে বলে অভিযোগ দমদমের তরুণ সেনগুপ্তের। তিনি বলেন, “মাসখানেকের মতো ওই অফিসে ঢুঁ মারার পরে তবেই পাওয়া গিয়েছে ডুপ্লিকেট কপি।” তবে তরুণবাবুকে ‘ভাগ্যবান’ বলেই মনে করছেন ওই অফিসে কাজে আসা ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসারেরা। তাঁদের দাবি, অনেকেই আছেন যাঁরা মাসখানেক বা তার বেশি সময় ধরে অফিসে আসার পরে জেনেছেন, ডুপ্লিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। এক ম্যারেজ রেজিস্ট্রার মিলনকুমার সাহার অভিযোগ, “সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমরাও প্রচণ্ড নাজেহাল হচ্ছি। আমরাও অনেক সময়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাই না।” ওই দফতর সূত্রে খবর, প্রতি দিনই অন্তত ১৫-২০ জন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিসে ফাইল জমা দেন। ডুপ্লিকেটের খোঁজে আসেন শতাধিক মানুষ। অথচ, রেকর্ড খুঁজে দিতে রেকর্ড সাপ্লায়ার পদে মাত্র এক জন। এক আধিকারিকেরই বক্তব্য, এক জন রেকর্ড সাপ্লায়ারের পক্ষে নির্দিষ্ট সময়ে রেকর্ড খুঁজে পাওয়া কার্যত অসম্ভব।
রাজ্য সরকারের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ম্যারেজের অফিসের জেলায় কোনও শাখা নেই। ফলে উত্তরবঙ্গের ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকেও প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিতে এই অফিসেই আসতে হয়। রেজিস্ট্রির ডুপ্লিকেট কপি দরকার হলে ওই অফিসে আসতে হয় বাঁকুড়ার বাসিন্দাকেও। ওই অফিসটিতে স্থান সঙ্কুলান না-হওয়ায় এখন মহাকরণের এ ব্লক, শিয়ালদহ কোর্টের একটি ঘর-সহ আরও চারটি জায়গায় নতুন রেকর্ড রুম খোলা হয়েছে। কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটছে না বলে জানালেন রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ম্যারেজেস নন্দনকুমার রায়।
নন্দনবাবু বলেন, “এই অফিসের আধুনিকীকরণের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো অনুমোদন মিলেছে। রেকর্ড রাখার জন্য আমাদের আরও ঘর দরকার। বেশ কয়েকটি পদও ফাঁকা রয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানিয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “এখনই সব বিয়ের কম্পিউটারাইজড নথিভুক্তিকরণ দরকার। কয়েকটি কম্পিউটার এসে পড়েও রয়েছে। কিন্তু জায়গার অভাবে বসাতে পারছি না।” |