তিন দিনে আত্মহত্যা তিন চাষির, কারণ নিয়ে দ্বন্দ্ব
মালদহের হবিবপুর, ১৩ জানুয়ারি।
বর্ধমানের পূর্বস্থলী, ১৪ জানুয়ারি।
বর্ধমানেরই কালনা, ১৫ জানুয়ারি, রবিবার।
পরপর তিন দিনে রাজ্যে আত্মঘাতী হয়েছেন তিন চাষি। আত্মহত্যার পিছনের কারণ হিসেবে পরিবারগুলি যে দাবি করছে (মূলত ফসলের দাম না পাওয়া), প্রশাসন তা মানতে নারাজ। কিন্তু চলতি মরসুমে ফসলের দাম না পেয়ে এ দিন পর্যন্ত রাজ্যে ২০ জন কৃষিজীবী আত্মঘাতী হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন বিরোধীরা। ‘চাষি আত্মহত্যার’ প্রশ্নে তৃণমূল নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের নিয়মিত সমালোচনা শুরু করেছেন জোটের শরিক কংগ্রেস নেতৃত্বও।
শুক্রবার হবিবপুরে গাছে ঝুলন্ত দেহ মেলে হরিদাস রত্ন নামে এক ধানচাষির। পরিবারের অভিযোগ, ধানের দাম না পেয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়াতেই তিনি আত্মঘাতী হন। তবে মালদহের জেলাশাসক শ্রীমতি অর্চনার বক্তব্য, “মানসিক অবসাদে ওই চাষি আত্মহত্যা করেছেন।” পূর্বস্থলীতে শনিবার তাপস মাঝি নামে এক প্রান্তিক-চাষির আত্মহত্যার ঘটনায় ধানের দাম না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল পরিবারের তরফে। বর্ধমানের জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা অবশ্য এ দিন বলেন, “তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই চাষি গত দু’বছর ভাগ-চাষ করেননি। ওঁর নিজের জমিতে যে ধান হয়, তা দিয়ে সারা বছর ওঁর পরিবারের খাওয়া চলে। এ বারও তেমনই ফলন হয়েছিল। তাই চাষে বিপর্যয়ের জন্য আত্মহত্যার কথা ঠিক নয়।”
কালনায় শোকস্তব্ধ পরিবার। ছবি: কেদারনাথ ভট্টাচার্য
আত্মঘাতী চাষিদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন কালনা ১ ব্লকের ঘনশ্যামপুরের চাষি রবীন্দ্রনাথ পাত্র (৩০)। পরিবারের দাবি, গত বছর প্রায় পাঁচ কাঠা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথবাবু। তা থেকে পাওয়া ১৫ বস্তা (বস্তাপিছু ৫০ কেজি) আলু হিমঘরে রেখেছিলেন। পাশাপাশি, ব্যবসার খাতিরে তিনি অন্য চাষিদের থেকে বেশ কিছু আলুর বস্তার বন্ড কিনেছিলেন বলে জানান তাঁর খুড়তুতো দাদা শঙ্কর পাত্র। মৃতের স্ত্রী ঝর্নাদেবী জানান, শনিবার দুপুরে বাড়িতেই কীটনাশক খান রবীন্দ্রনাথবাবু। কালনা হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে রবিবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।
ঝর্নাদেবীর অভিযোগ, “আলু চাষ ও ব্যবসার জন্য বেশ কিছু ঋণ হয়ে গিয়েছিল। সে কথা মাঝেমধ্যেই বলতেন। দেনার চাপেই উনি আত্মহত্যা করলেন।” মহকুমাশাসক (কালনা) সুমিতা বাগচি অবশ্য বলেন, “গত ১২ জানুয়ারি ঘনশ্যামপুরে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ও আবগারি দফতর বহু লিটার চোলাই বাজেয়াপ্ত করে। বেআইনি চোলাই ব্যবসা চালানোর জন্য আবগারি দফতর যে তিন জনের নামে মামলা দায়ের করেছে, রবীন্দ্রনাথবাবু তাঁদের অন্যতম। এ ছাড়াও আমরা জেনেছি, ওই ব্যক্তি আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।” মৃতের স্ত্রী অবশ্য চোলাই ব্যবসায় রবীন্দ্রনাথবাবুর জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। জেলাশাসক বলেন, “বিডিও-কে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ জানতে বিশদে তদন্তে হচ্ছে।”
জেলায় জেলায় আলু চাষি এবং ব্যবসায়ীদের ‘পরিস্থিতি’ কী? রবিবারই বর্ধমানে ‘প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি’র রাজ্য সভাপতি লালু মুখোপাধ্যায় দাবি করেছেন, “গত বার রাজ্যে আলু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে সাত থেকে পৌনে আট লক্ষ মেট্রিক টন। প্রায় ৬ লক্ষ মেট্রিক টন আলু মজুত করা হয়েছিল রাজ্যের হিমঘরগুলিতে। কিন্তু সরকার পরপর দু’দফায় হিমঘরে মজুত আলুর সংরক্ষণের মেয়াদ বৃদ্ধি করে তা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করলেও, হিমঘরগুলিতে এখনও জমে রয়েছে অন্তত ২৫ লক্ষ বস্তা অর্থাৎ প্রায় দেড় লক্ষ মেট্রিক টন আলু। তার মধ্যে দুই মেদিনীপুরে প্রায় ১৮ লক্ষ, হুগলিতে ৪ লক্ষ এবং বর্ধমান ও বাঁকুড়ায় প্রায় ৪ লক্ষ বস্তা জমে রয়েছে।” সমিতির অনুমান, এ বার রাজ্যে আলুর উৎপাদন বেড়ে ৯ লক্ষ মেট্রিক টনে দাঁড়াতে পারে। সরকার এখনই মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ আলু কেনায় উদ্যোগী না হলে চাষিদের আলুর অভাবি বিক্রি করতে হবে বলে সংগঠনটির দাবি।
বস্তুত, আলু ব্যবসায়ী সমিতির দাবির সমর্থন মিলেছে কালনার ঘনশ্যামপুর এলাকার আলু চাষি অমর সরকার, বাপিনাথ চক্রবর্তী, জগবন্ধু ঘোষেদের কথায়। তাঁদের দাবি, “আমরা সাধারণত জ্যোতি আলু চাষ করি। গত বছর যখন জ্যোতি আলু ওঠে, বস্তাপিছু দাম ছিল ২৩০-২৪০ টাকা। এখন ৫০ কেজির বস্তার দাম এতটাই পড়ে গিয়েছে যে, সংসার চালানোই দায়। এত লোকসান হলে চাষি বাঁচবে কী করে?” হুগলিরও কিছু আলু চাষি জানিয়েছেন, গত মরসুমের জ্যোতি আলুর বস্তা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। সম্প্রতি মালদহের চাঁচলে মেয়াদ ফুরনোর পরেও চাষিরা না নেওয়ায় প্রায় দু’হাজার বস্তা আলু বিলিয়ে দেন হিমঘর কর্তৃপক্ষ। ওই আলু বেচতে নিলাম ডাকা হলেও কেনার লোক পাওয়া যায়নি।
কেন এমন হচ্ছে? ‘প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি’র বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক সাগর সরকারের অভিযোগ, “কৃষি বিপণনমন্ত্রীকে হিমঘরে আলু জমে যাওয়া ও লোকসানের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল জুলাইতেই। কিন্তু সরকার উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করেছে। সমিতির প্রতিনিধিদের আলু সংক্রান্ত প্রশাসনিক বৈঠকগুলিতে রাখার জন্য বারবার দাবি জানাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে তাঁরা সরকারকে সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতে পারতেন। কিন্তু সরকার এখনও সে দাবি মানেনি।”
রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় অবশ্য বলছেন, “আলুর ফলন বেশি হওয়ার জন্যই এ বার সমস্যা হয়েছে।” তাঁর আশ্বাস, “আলু দিয়ে তৈরি সামগ্রীর উৎপাদন করার শিল্প তৈরির চেষ্টা করা হবে। প্রথমে সরকারি, পরে বেসরকারি স্তরে এই শিল্প স্থাপনের চেষ্টা হবে। বিদেশে সরাসরি আলু রফতানির চেষ্টাও চালানো হবে। আর ধানের ক্ষেত্রে খাদ্য দফতর পরিকাঠামোগত কিছু ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখেছে। প্রয়োজনীয় গুদামঘর এবং প্রতিটি ব্লকে অন্তত চারটি করে চালকল তৈরির দাবি জানানো হয়েছে। তা হলে ন্যূনতম সহায়ক মূলে চাল সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কোনও অসুবিধা হবে না।” আলু ব্যবসায়ী সমিতির অভিযোগের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “গত বছর আলু উঠেছিল জানুয়ারিতে। আমরা ক্ষমতায় আসি মে মাসে। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কিছুটা সময় তো লাগবেই।”
কিন্তু চাষিদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে রাজ্য সরকারের ‘সদিচ্ছা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা। সরকারকে ‘কটাক্ষ’ করে এ দিন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “সরকার বলছে, টাকা নেই। কিন্তু ওরাই (রাজ্য সরকার) দিঘার সৈকত উৎসবে দেড় কোটি টাকা খরচ করছে। অন্য দিকে, টাকার অভাবে একের পরে এক কৃষক আত্মহত্যা করছেন!”
হাইকম্যান্ডের নির্দেশে প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ‘সুর নরম’ করলেও কৃষক আত্মহত্যার প্রসঙ্গে সমালোচনা থেকে সরে আসেননি। এ দিন কৃষ্ণনগরের এক সভায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা সরকারকে সব রকম ভাবে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু যদি না অনাহারে চাষিদের মৃত্যু হয়, বা চাষিদের আত্মঘাতী হতে হয়, তবে আমরা তার প্রতিবাদ করব। কেন এত চাষি আত্মঘাতী হবেন? কেন এই নিয়ে তদন্ত কমিশন হবে না?” তাঁর সংযোজন, “দিঘার সৈকত উৎসব নিয়ে আমার আপত্তি নেই। হাজারবার উৎসব হোক। কিন্তু চাষিরা যেন ফসলের ন্যায্য দাম পান।” রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “যথাযথ উত্তর ঠিক সময়ে দেব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.