রাতভর হই হুল্লোড়। সাউন্ড বক্সে টুসু বন্দনা। আর ভোরে চৌডল নিয়ে গিয়ে নদীতে বিসর্জন। সঙ্গে পিঠে পুলির স্বাদ। বাড়িতে বাড়িতে টুসু পরবের সেই ছবিটা মাওবাদীদের ভয়ে প্রায় ভুলতে বসেছিলেন পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার মানুষ। এই বার সেই পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। এলাকার পরিবেশ বেশ শান্ত। টুসু পরবের সেই জমকালো দিনগুলি রবিবার মকরসংক্রান্তির ভোরে ফিরে পেল বাঁকুড়া-পুরুলিয়া। টুসু পরব আর মেলায় মেতে উঠলেন কচিকাঁচা থেকে বয়স্করা। |
পুরুলিয়ার জেলা কৃষি দফতরের উপ অধিকর্তা অশ্বিনীকুমার কুণ্ডু জানান, রবিবার ছিল জেলার শীতলতম দিন। কিন্তু শীত উপেক্ষা করেই ঝাড়খণ্ড সীমান্তে সুবর্ণরেখার তীরে তুলিনে, কংসাবতীর তীরে দেউলঘাটায়, মহাদেববেড়ায় বা কুমারী নদীর তীরে দুয়ারশিনি ঘাটে, গন্ধেশ্বরী, দামোদর, জয়পণ্ডা, শালি নদীর তীরে ভোর থেকে মানুষের ঢল নেমেছে। উৎসবমুখর মানুষজন ভিড় জমিয়েছেন পুটিয়ারি জলাধার, কয়রাবেড়া জলাধার, মুরগুমা জলাধার, ইন্দ্রবিল জলাধার বা পুরুলিয়া শহরের উপকন্ঠে কংসাবতীর তীরে। অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে শোভা নদীর তীরেও স্নানের জন্য ভিড় করেছেন মানুষ। হাজার হাজার নারী পুরুষের হাতে রঙীন চৌডল। সেই চৌডলের ভেলায় টুসুকে সাজিয়ে গান গাইতে গাইতে মেয়ে বউরা নদীতে বিসর্জন দিতে চলেছেন, এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছে বিভিন্ন প্রান্তে।
মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলা বসেছিল বিভিন্ন এলাকায়। কংসাবতী জলাধার লাগোয়া রানিবাঁধের পরেশনাথ মন্দিরে বাউলমেলা, পরকুলে একদিনের মেলা বসেছিল। শিলাবতী নদী তীরবর্তী সিমলাপালের আনন্দপুরে এ দিন থেকেই শুরু হয়েছে গঙ্গামেলা। সাতদিন ধরে চলবে এই মেলা। মেলায় লোকসমাগমও হয়েছে প্রচুর। দামোদরের গা ঘেঁষা পাত্রসায়রের চরগোবিন্দপুরে হচ্ছে গ্রামীণ মকর মেলা। পাঁচদিনব্যাপী এই মেলায় বাউল গান, নাটক, যাত্রার পাশাপাশি যুক্তিবাদী তর্জাগানও মুখ্য আকর্ষণ। |
নদীর পাড়ে গান গাইছিলেন নলকুড়ি গ্রামের পুতুল মাহাতো, সুবেশা মাহাতোরা। বললেন, “বছরের এই দিনে ঘরে থাকা যায় না। টুসু ভাসানের মেলায় আসবই।” মহাদেববেড়ার মেলায় স্থানীয় পিঁড়রা গ্রামের বাসিন্দা সুলেখা মাহাতো, বিনতা মাহাতোরা এসেছিলেন কংসাবতীর জলে টুসু বিসর্জন দিতে। বললেন, ‘‘ এই পরবে প্রাণের টান। শীত কী আর আটকে রাখতে পারে!” পুরুলিয়ার মকর পরব দেখতে এসেছেন স্টক হোম থেকে জন মোল্ডন বা লন্ডন থেকে রবার্ট লুস। জনের কথায়, “আগেও এসেছি মকর ফেস্টিভ্যালে। দারুণ লাগছে।”
অন্য দিকে মেলার পসার সাজিয়েছেন যাঁরা, তাঁদেরও বিক্রি হয়েছে ভাল। টুসু গানের সিডির বিক্রি বেড়েছে। আড়শা থানার সিবকাবাদ গ্রাম থেকে লরি বোঝাই আখ নিয়ে এসেছিলেন ফুলু মাঝি। তিনিও বললেন, “মেলাতে আখের বিক্রি এ বছর ভালই হয়েছে।”
শুধু মেলা নয়, এ দিন পিকনিকেও মাতলেন অনেকে। পরকুলে মেলা দেখতে আসা সারেঙ্গার নমিতা সর্দার, রাধারাণী মাহাতোরা বললেন, “সকালে কংসাবতীতে মকর স্নান করলাম। পিকনিকও করেছি। দুপুরে মেলা দেখে বাড়ি ফিরছি।” পাত্রসায়রের চাঁদনিতেও জমে উঠেছিল চড়ুইভাতির আসর। স্থানীয় বাসিন্দা টোটন রজক, মণিরুল ইসলাম বলেন, “মেলা দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হল না। তাই চাঁদনিতে পিকনিক সারলাম!”
সব মিলিয়ে মকর সংক্রান্তির দিন টুসু উৎসবের পুরনো ছবিটা আবার ফিরে এসেছে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায়। কমর্ব্যস্ত জীবনে টুসু পরবের আয়োজন কমতে থাকলেও ভাসানের দিন কিন্তু ফাঁক ছিল না কোনও।
|
ছবিগুলি তুলেছেন শুভ্র মিত্র, সুজিত মাহাতো, প্রদীপ মাহাতো ও মুকুটমণিপুর উমাকান্ত ধর। |