|
|
|
|
সন্ত্রাস ভুলে মকর-পরবের আনন্দে মাতল জঙ্গলমহল |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
বিগত তিন বছরের সন্ত্রাস ভুলে এ বার মকর-পরবে মেতে উঠেছে জঙ্গলমহল। আদিবাসী, কুর্মি বা মাহাতো-সহ মূলবাসীদের প্রধান এই উৎসবকে ঘিরে জঙ্গলমহলের সর্বত্রই খুশির জোয়ার। তবে রাজ্য সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এখনও অধিকাংশ জায়গায় সরকারি সহায়ক মূল্যে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনা শুরু হয়নি। এর ফলে ফড়েদের পোয়া বারো। অনেক কম দামে চাষির ঘর থেকে ধান কিনে নিচ্ছে ফড়েরা। উৎসবের আয়োজন করতে এবং ছেলেপুলে-পরিজনদের নতুন জামা-কাপড় কেনার জন্য ফড়ে ও মহাজনদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন প্রান্তিক ও ছোট চাষিরা। যে কারণে, অভাবের সংসারে এ বার অনেক বাড়িতে উৎসবের আয়োজন করতে হয়েছে সাদামাঠা ভাবে। আয়োজনে আড়ম্বর না-থাকুক, ‘সন্ত্রাস-মুক্ত’ জঙ্গলমহলে এ বার ফিরে এসেছে উৎসবের সেই পুরনো চেনা ছবি। গ্রামে-গ্রামে উৎসবের মেজাজ। মোরগ-লড়াই। পার্বণি-মেলা। |
|
সুবর্ণরেখায় টুসু বিসর্জন। নিজস্ব চিত্র |
জঙ্গলমহলে পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতটা টুসু পুজোর রাত। শনিবার রাতভর আদিবাসী-মূলবাসীদের বাড়িতে টুসু পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। ফল-মূল, পিঠে ও খই-মুড়কির নৈবেদ্য সাজিয়ে এক রাতে ষোলো বার টুসুমণির পুজো করেন কুমারী ও এয়োতিরা। সারারাত গান শুনিয়ে ‘জাগিয়ে রাখা’ হয়েছিল সমৃদ্ধির দেবী টুসুমণিকে। এ দিন বাড়ি-বাড়ি ‘আউছি’ চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয়েছিল পিঠে। রবিবার ছিল টুসুর ভাসান। এ দিন সকাল থেকেই জঙ্গলমহলের বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে টুসু মূর্তি বিসর্জন দেওয়া শুরু হয়। টুসু ভাসানের পরে নদী বা জলাশয়ে স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরেন সকলে। প্রথা মতো তিলজাত মিষ্টি ও রকমারি পিঠে তৈরি হয়েছে। যাঁরা কর্মসূত্রে দূরে থাকেন, তাঁরা বাড়িতে ফিরে এসেছেন। এ দিনই সাবেক প্রথা মেনে আদিবাসী, কুর্মি-সহ মূলবাসীদের বাড়িতে তৈরি হয়েছে মাংসের পুর দেওয়া সুস্বাদু ‘মাঁস পিঠা’।
সোমবার পয়লা মাঘ। কুর্মি বা মাহাতো সম্প্রদায়ের নতুন বছর (কুর্মালি নববর্ষ)। এই দিনটি ‘এখ্যান যাত্রা’ অর্থাৎ যে কোনও শুভ কাজের জন্য প্রশস্ত বলে মনে করা হয়। বছরের প্রথম দিনটিতে কুর্মি-কৃষকেরা জমিতে ‘হালচার’ করেন। তিন বার লাঙল চালিয়ে প্রতীকী কর্ষণ করা হয়। পয়লা মাঘের দিনটিতে আবার আদিবাসীদের গ্রামে গ্রামে ‘গরাম থানে’ অর্থাৎ গ্রাম-দেবতার স্থানে পশু-উৎসর্গেরও রেওয়াজ আছে।
লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মকর-পরব জঙ্গলমহলের ‘পৌষালি নবান্ন’। নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দে লক্ষ্মীস্বরূপা সমৃদ্ধির দেবী টুসুমণিকে পুজো করা হয়।” ঝাড়গ্রামের ধবাধোবিন গ্রামের গৃহবধূ কাজল মাহাতো বলেন, “অশান্তির কারণে গত তিন বছর কার্যত নিয়ম রক্ষার মকর-পরব হয়েছিল। পরিস্থতি স্বাভাবিক হওয়ায় দুঃখ-কষ্ট ভুলে উৎসবে সামিল হয়েছি।”
তবে, কৃষি-কেন্দ্রিক মকর-পরবে মন ভাল নেই লালগড়ের বাঘঘরা গ্রামের দীপক মাহাতো, বেলপাহাড়ির ভেদাকুই গ্রামের অর্জুন মাহাতো কিংবা ঝাড়গ্রামের কাশিয়া গ্রামের লাগদু হাঁসদার মতো অনেক চাষির। তাঁদের বক্তব্য, “সারের দাম আকাশ ছোঁয়া। চাষের খরচ বহুগণ বেড়েছে। অথচ আমরা ধানের দাম পাচ্ছি না। সরকারি সহায়ক মূল্যে ধান কেনা শুরুই হয়নি। ধান বেচে যে দুটো পয়সার মুখ দেখব তা হচ্ছে কোথায়?” উৎসবের মধ্যেও চাষিদের মনে তাই বেদনার সুর। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা খাদ্য-সরবরাহ নিয়ামক প্রদীপ ঘোষের দাবি, “সব ব্লকেই সরকারি সহায়ক মূল্যে ধান কেনা শুরু হয়েছে। তিন লক্ষ মেট্রিক টন পর্যন্ত ধান কেনা হবে।” যদিও জেলায় এ বার প্রায় ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন ধানের ফলন হয়েছে। ফলে চাষিদের প্রয়োজনের তুলনায় সরকারের উদ্যোগ সিন্ধুতে বিন্দুবৎ। |
|
|
|
|
|