১৩ জানুয়ারি ২০১১ এক বিরল দিন। ভারতে এই প্রথম পূর্ণ একটি বৎসর কোনও পোলিয়ো সংক্রমণের ঘটনা ঘটে নাই। জনস্বাস্থ্যের নিরিখে ইহাকে এভারেস্ট শীর্ষে উঠিবার পূর্বে শেষ বেস ক্যাম্পে পৌঁছাইবার সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। পরপর তিন-চার বৎসর পোলিয়ো সংক্রমণহীন থাকিতে পারিলে একটি দেশকে ‘পোলিয়োমুক্ত’ বলিয়া ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেই লক্ষ্য দুই বৎসর পূর্বেও অসম্ভব বলিয়া মনে হইতেছিল ২০০৯ সালে বিশ্বে সংক্রমণের অধিকাংশই ঘটিয়াছিল ভারতে। সে বৎসর এ দেশের ৭৪১টি শিশু পোলিয়ো আক্রান্ত হইয়াছিল। কিন্তু ২০১০ সালেই সেই সংখ্যা নামিয়াছিল বিয়াল্লিশটিতে। শেষ পোলিয়ো সংক্রমণের খবর মিলিয়াছিল পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার পাঁচলাতে। অতএব এ রাজ্যের নিকটও পোলিয়োমুক্তির প্রথম বৎসরটি স্বস্তি আনিয়াছে। অবশ্যই এই কৃতিত্ব কোনও একটি রাজ্যের নহে। উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার হইতে এ রাজ্যে সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব ছিল বেশি। এই দুটি রাজ্য যে টিকাকরণকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়াছে, পোলিয়ো দূরীকরণ প্রকল্পের কাজে প্রশাসন এবং সমাজের নানা স্তরের মানুষকে উদ্যোগী করিতে পারিয়েছে, তাহার সুফল পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা দেশ লাভ করিয়াছে। জনসমাজের যে অংশগুলি পোলিয়ো টিকাকরণের প্রতি বিদ্বিষ্ট এবং ভীত ছিল, তাহাদেরও এখন এই প্রকল্পে যুক্ত করা গিয়াছে। বহু ব্যর্থতা, বহু পরিশ্রমের পর এই সাফল্য আসিয়াছে, তাই সার্থকতার বোধটিও বড় মূল্যবান। যে রোগ দরিদ্র শিশুদের কর্মশক্তি, জীবনীশক্তি নষ্ট করিয়া পরনির্ভর জীবনযাপন করিতে বাধ্য করিত, বিশ্ব হইতে তাহাকে মুছিয়া ফেলিবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হইয়াছে। চারটি দেশে পোলিয়ো এখনও গুরুতর আকার ধারণ করিয়া রহিয়াছে: ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া ও আফগানিস্তান। ভারত বৃহত্তম হইবার কারণে বিশ্বের পোলিয়োমুক্তির পক্ষে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণও বটে।
এই সাফল্য একটি বড় সম্ভাবনা নির্দেশ করে। স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের অধিকাংশই চিকিৎসার কাজে ব্যয় হইয়া থাকে, রোগ প্রতিরোধের বরাদ্দ তুলনায় কম। পোলিয়ো টিকা প্রকল্পটি দেখাইয়া দিল, গোটা বিশ্ব হইতে একটি রোগ দূর করিতে প্রচুর অর্থ এবং অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হয় সত্যই, কিন্তু সম্পূর্ণ মানবজাতি বহু প্রজন্ম ধরিয়া তাহার সুফল ভোগ করিতে পারে। ফলে টিকাকরণ, মশা-মাছি প্রভৃতি রোগসংবাহক নিবারণ, পয়ঃপ্রণালী এবং পানীয় জলের উন্নতিকরণের মতো জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলিতে অধিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। কথাটি নূতন নহে, কিন্তু রোগপ্রতিরোধের উপযোগিতা কত সুদূরপ্রসারী, তাহা পোলিয়ো টিকাকরণ আবারও প্রমাণ করিল। দুঃখের বিষয়, আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার উদ্যোগের কারণে পোলিয়ো দূরীকরণ যথাযোগ্য গুরুত্ব পাইয়া থাকিলেও শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট অন্যান্য টিকাগুলি ভারতে গুরুত্ব পাইতেছে না। অর্ধেকেরও বেশি শিশুর সকল টিকাকরণ সম্পূর্ণ হইতেছে না। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে মাত্র ৪৩ শতাংশ শিশু যক্ষ্মা, টিটেনাস, হাম, ডিপথেরিয়া প্রভৃতি সকল টিকা যথাসময়ে পাইতেছে। গ্রামে এবং অল্পশিক্ষিত পরিবারে এই অনুপাত আরও কম। দরিদ্র শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকিয়া যাইতেছে, ফলে তাহাদের দরিদ্র থাকিবার সম্ভাবনাও বাড়িতেছে। সকল প্রতিরোধযোগ্য রোগের নির্মূলীকরণের জন্যই যথাযোগ্য বিনিয়োগ এবং মূল্যায়ন-পরিদর্শন করিতে হইবে। |