জমি অধিগ্রহণে রাজ্য সরকারের কোনও ভূমিকা থাকিবে না এবং শিল্পপতিদেরই জমি-মালিকদের কাছ হইতে প্রয়োজনীয় জমি খরিদ করিতে হইবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের এই জমি-নীতি সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কপালে ভাঁজ ফেলিয়াছিল। তাঁহাদের আশ্বস্ত করিতে মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছিলেন, জমি কোনও সমস্যা হইবে না, কেননা সরকারের জমি-ব্যাংক হইতেই প্রয়োজনীয় জমি মিলিবে। সেই ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ এবং গুণমান সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভবত কোনও ধারণা ছিল না। বস্তুত, সে-ভাবে রাজ্যের ভূমি-ব্যাংক তৈয়ারিই হয় নাই। এখন যখন অধিকাংশ সরকারি দফতর সরকারে ন্যস্ত জমির পরিমাণের প্রাথমিক হিসাব লইয়া হাজির, দেখা যাইতেছে, রাজ্যের আড়াই লক্ষ একর খাস জমির ৯০ শতাংশই খণ্ড-খণ্ড এবং ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো, এক লপ্তে লভ্য নয়। এই খণ্ডিত ছড়ানো জমি বৃহৎ শিল্প স্থাপনের উপযোগী নয়। যে-সব জমি একলপ্তে কয়েকশো একর, সেগুলিও অধিকাংশই পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া কিংবা বীরভূমের প্রত্যন্ত প্রদেশে অবস্থিত, অথবা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলিতে। হয় ওই সব এলাকায় আইনশৃঙ্খলার সমস্যা রহিয়াছে, নতুবা পরিকাঠামোর, যে-জন্য লগ্নিকারীরা সেখানে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী নন।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিতেছে, অতঃপর রাজ্যের শিল্পায়নের কী হইবে? মুখ্যমন্ত্রী যে জমি-ব্যাংকের গল্প শুনাইয়াছিলেন, দেখা যাইতেছে, তাহা একটি ইচ্ছাপূরণের রূপকথা। কিছু কাল আগেই একটি নামী প্রতিষ্ঠান ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প নির্মাণে সরকারের কাছে এক লপ্তে ১২০০ একর জমি চাহিয়াছিল। তেমন কোনও জমি রাজ্যের হাতে নাই। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা ইস্পাতের মতো প্রকল্পে এই পরিমাণ জমিই লাগে। সংলগ্ন জমির অভাবে কাটোয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজেও হাত দেওয়া যাইতেছে না। উপরন্তু ভূমি-ব্যাংকের যে প্রাথমিক চিত্রটি প্রকাশিত, তাহাতে রাজ্যে শিল্পায়নের সম্ভাবনা করুণ। জমি-অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সরকারি নীতিটি অতএব পুনর্বিবেচনার যোগ্য। অধিকাংশ জমি যদি বা লগ্নিকারীরা নিজেরা খরিদ করিয়া লন, তথাপি বৃহৎ শিল্পের প্রয়োজনীয় বিপুল জমির কিছু অংশ সরকারকে অধিগ্রহণ করিতে হইতে পারে। বিশেষত জমি-মালিক যেখানে ইচ্ছাকৃত ভাবে অবিশ্বাস্য রকম চড়া দর হাঁকিয়া একটি প্রকল্পের রূপায়ণ আটকাইয়া দিতে বদ্ধপরিকর। প্রয়োজনে জমি-হারাদের ক্ষতিপূরণের অঙ্ক সংশোধিত হউক, কিন্তু কয়েকটি ছোট খণ্ড জোতের মালিকের একগুঁয়েমির জন্য একটি গোটা প্রকল্পের রূপায়ণ আটকাইয়া গেলে সরকারের হস্তক্ষেপ অপরিহার্য।
শিল্পায়ন বা উন্নয়নে জমি-অধিগ্রহণে যে সরকারের ভূমিকা থাকা উচিত, ইহা সারা বিশ্বেই স্বীকৃত নীতি। কলিকাতা সফররত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজও সে দিন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণের দৃষ্টান্ত দিয়া তাহা তুলিয়া ধরিয়াছিলেন। বিনিয়োগকারীকে রাস্তা-ঘাট-বিদ্যুৎ বর্জিত, ঈশ্বরপরিত্যক্ত এলাকায় শিল্প গড়িতে বলিলে তিনি উৎসাহী হইবেন কেন? নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে, এমন অঞ্চলেও তিনি সহসা বিনিয়োগেচ্ছু হইবেন না। আগে শিল্প গড়ুন, পরে রাস্তাঘাট বানাইয়া দিব কিংবা নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করিব, এমন আশ্বাসেও কেহ লগ্নি করিতে ছুটিয়া আসিবেন না। এক লপ্তে উন্নত পরিকাঠামো-যুক্ত জমিই লগ্নিকারীদের অভিপ্রেত। বেসরকারি উদ্যোগে শিল্পায়ন চাহিলে সরকারকে সেই জমির ব্যবস্থা করিয়া দিতে হইবে। সেই সঙ্গে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনও অচিরে রদ করা দরকার। বর্তমানে দেশে পশ্চিমবঙ্গই সম্ভবত একমাত্র রাজ্য, যেখানে আইনটি এখনও বলবৎ। |