ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নবজাতক চুরির ঘটনায় ফর্সা, গোলগাল, মাঝারি উচ্চতার এক মহিলাকে পুলিশ খুঁজছে। খোয়া যাওয়া শিশুর মা ও ওই ওয়ার্ডের একাধিক প্রসূতির সঙ্গে কথা বলে এ পর্যন্ত চারটি স্কেচ এঁকেছে পুলিশ। দেখা গিয়েছে, প্রতিটি ছবির মধ্যেই কিছু না কিছু মিল রয়েছে। স্কেচ আঁকার আগে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ঘটনার সময় কর্তব্যরত বেশ কয়েক জন নার্স ও আয়াকেও। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত শিশু-চুরির কোনও কিনারা হয়নি।
শুক্রবার বিকেলে তপসিয়ার বাসিন্দা কানিজ বেগমের দু’দিনের পুত্রসন্তান হাসপাতালের মহিলা বিভাগের তিনতলা থেকে চুরি যায় বলে অভিযোগ। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, এই চুরির সঙ্গে অন্তত দু’জন মহিলা জড়িত। মহিলা বিভাগের একতলার গেটে লাগানো ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) থেকে পাওয়া ফুটেজেও দেখা গিয়েছে, শুক্রবার দুপুরে বোরখা পরা দুই মহিলা ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। তাদের এক জনের হাতে ছিল ওয়ার্ডে ঢোকার সবুজ রঙের ছাড়পত্র। কানিজ বেগমও পুলিশকে বলেছেন, ওই দিন যে মহিলা তাঁর সঙ্গে ভাব জমিয়ে সদ্যোজাত ছেলেকে কোলে তুলে এ দিক-ও দিক নিয়ে গিয়েছিল, তারও হাতে ছিল একই রকম কার্ড।
তা হলে ওই সন্দেহভাজন মহিলা কোথায় পেল সবুজ কার্ড যা কেবল রোগীর বাড়ির লোকের হাতে দেওয়া হয়? পুলিশ বলছে, কার্ডে চিকিৎসাধীনের নামধাম, ওয়ার্ড ও শয্যা নম্বর লেখা থাকলেও গেটে তেমন ভাবে পরীক্ষা করা হয় না। হাতে সবুজ কাগজ দেখলেই রক্ষীরা ওয়ার্ডে ঢুকতে দেন। এ ক্ষেত্রে শিশু চোরেরা ভুয়ো কার্ড নিয়েই মহিলা বিভাগের তিনতলায় উঠেছিল বলে অনুমান তদন্তকারী অফিসারদের।
হাসপাতালে শুয়ে কানিজ বেগম এ দিন পুলিশকে বলেছেন, অল্পবয়সী এক মহিলা সে দিন ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে মায়েদের সাহায্য করছিল। তিনিও ওকে তাঁর পেটে ব্যথার কথা জানান। সে একটি ওষুধ এনে খাইয়ে দেয়। এর পরেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন কানিজ বেগম। হুঁশ আসার পরে দেখতে পান, শয্যার পাশে ছেলে নেই। ওই মহিলাও উধাও হয়ে গিয়েছে।
তা হলে ওই মহিলার কি আগে থেকেই আসা-যাওয়া ছিল হাসপাতালে? নার্স ও আয়াদের একাংশের সঙ্গেও কি পরিচয় ছিল তার? আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা। কী ভাবে ‘ভিজিটিং আওয়ার্স’-এর আগে মহিলা বিভাগে বাইরের লোক ঢুকল, কেনই বা কর্তব্যরত নার্স-আয়ারা তা মেনে নিলেন, এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে পুলিশ। এক পুলিশকর্তা বলেন, “বোরখা পরলে নিজের পরিচয় গোপন করার পাশাপাশি খুব সহজেই সদ্যোজাতকে লুকিয়ে নেওয়া যায়।”
প্রশ্ন উঠেছে, ভর বিকেলে মহিলা বিভাগের গেট দিয়ে এক মহিলা সদ্যোজাতকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেও নিরাপত্তাকর্মীরা কেউ তাঁর কাছে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট বা সংশ্লিষ্ট নথি দেখতে চাইলেন না কেন? হাসপাতালের সুপার পার্থ প্রধান বলেন, “ঘটনার দিন গেটে তিন জন নিরাপত্তাকর্মী ও দু’জন পুলিশ ছিলেন। প্রতি মুহূর্তে এত মানুষ ওয়ার্ডে আসা-যাওয়া করেন যে প্রত্যেকের কার্ড বা কাগজপত্র যাচাই করা কার্যত অসম্ভব।”
এ তো গেল ওয়ার্ডের বাইরের চেহারা। কিন্তু চিকিৎসক ও নার্স-আয়াদের উপস্থিতিতে কী ভাবে ওয়ার্ডের ভিতর থেকে বাচ্চা চুরি হয়ে যায়? সুপারের বক্তব্য, “ঘটনার দিন তিনতলায় ৭১টি শয্যায় ১২৮ জন প্রসূতি ছিলেন। সঙ্গে ৭৪টি শিশু। সেখানে এক শিফটে ডিউটিতে থাকেন মাত্র চার জন নার্স ও দু’জন চিকিৎসক। তাঁদের পক্ষে এত জন রোগীর চিকিৎসা সামলে নজরদারি চালানো খুবই কঠিন।” শনিবার দুপুরে ওই মহিলা বিভাগে গিয়ে দেখা গেল, গেটে একাধিক নিরাপত্তাকর্মী। সবুজ রঙের কার্ড না দেখে কাউকে ছাড়া হচ্ছে না। হাসপাতালের কর্মীদের একাংশই অবশ্য বলছেন, এই তৎপরতা অন্য দিন দেখা যায় না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ দিন একটি তদন্ত রিপোর্ট স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জমা দিয়েছেন। তাতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, হাসপাতালের মধ্যেই শিশু চুরির চক্র এখনও সক্রিয় রয়েছে। তা হলে নজরদারির কী হবে? কারা নিরাপত্তা দেবেন প্রসূতি ও শিশুদের? স্বাস্থ্যসচিব বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “শনিবার থেকেই ওই হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে মহিলা রক্ষী মোতায়েন করা হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে সব মেডিক্যাল কলেজেই তা চালু হবে।” স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের অবশ্য মত, চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য বায়োমেট্রিক কার্ড চালু না হলে এ সমস্যা মিটবে না। আগামী তিন মাসের মধ্যে রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালে ওই কার্ড চালু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব। |