‘টোপ’: সংসদ-ভবনে ঢোকার কয়েকটি জাল পাস। রেল, কেন্দ্রীয় খাদ্য নিগম ও স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-র কয়েকটি ‘নিয়োগপত্র’ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে দহরম মহরমের লম্বা-চওড়া বুলি!
বেকার যুবকদের ফাঁদে ফেলতে এ সবই ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করেছিল একটি আন্তঃরাজ্য অপহরণ-চক্র। রেলে চাকরির আশায় ওই ‘অপহরণকারী’ তথা ‘জালিয়াত’দের পাল্লায় পড়ে বর্ধমানের একটি গোপন ডেরায় দিন দশেক ধরে ‘পণ-বন্দি’ হয়ে ছিলেন রাজস্থানের আলওয়ারের চার জন যুবক। শনিবার
ভোরে যৌথ অভিযানে বর্ধমানের প্যামরা গ্রাম থেকে তাঁদের উদ্ধার করেছে হাওড়া ও কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের তদন্তকারী দল। পুলিশের দাবি, অভিযুক্তদের মধ্যে সাত জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, ধৃতেরা হল কামেশ্বর সিংহ, প্রদীপ সাউ, সত্যপ্রকাশ পাসোয়ান, কৃষ্ণ যাদব, রমেশ থাপার, বিকাশ কুমার, এবং প্রদ্যুৎ বাগচি। সত্যপ্রকাশ থাকে বিহারে। বাকিরা বর্ধমানের বাসিন্দা। কামেশ্বরের ছেলে তারকেশ্বর সিংহই চক্রের পাণ্ডা বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। তার খোঁজ চলছে। আরও ক’জন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
হাওড়ার অতিরিক্ত ডিসি রশিদ মুনি খানের কথায়, “চাকরির টোপ দিয়ে শিকারদের ফাঁদে ফেলার আগে কোনও দুরভিসন্ধি বুঝতে দেয়নি অভিযুক্তরা। গোপন ডেরায় বন্দি করার পরেই তারা মুক্তিপণ দাবি করতে থাকে। অপহৃতদের দিয়ে তাঁদের আত্মীয়দের ফোন করিয়ে টাকার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। তাঁদের ব্যাঙ্ক
অ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম কার্ড ব্যবহার করে অন্তত আড়াই লক্ষ টাকা তোলা হয়েছে।” |
ঘটনার সূত্রপাত, অবশ্য বছর দেড়েক আগে। রাজস্থানের আলওয়ারের বাসিন্দা মোবিন খানের সঙ্গে নয়াদিল্লিতে ‘হেম করণ’ নামে এক ব্যক্তির আলাপ হয়েছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রের খবর, মোবিন চাকরি খুঁজছেন শুনে হেম তাঁকে আশ্বাস দেয়, তার সঙ্গে মন্ত্রী-পর্যায়ের অনেকের যোগাযোগ। রেল, সেইল বা রাষ্ট্রায়ত্ত কোনও ব্যাঙ্কে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া তার কাছে কোনও ব্যাপার নয়। চাকরি পেতে সাধু যাদব নামে পটনার এক বাসিন্দার ফোন নম্বরও মোবিনকে দেয় হেম।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, নয়াদিল্লি থেকে রাজস্থানে ফিরে এই চাকরির ‘খনি’-র কথা তাঁর পরিচিত গুরমেশ সিংহ, হংস রাজ ও রণবীর সিংহকেও জানিয়েছিলেন মোবিন। তাঁরা এক সঙ্গেই সাধু যাদবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
পুলিশি তদন্তে প্রকাশ, মাস ছ’য়েক আগে মোবিনদের পটনায় ডেকে পাঠায় সাধু। রেল-এর ‘জাল’ লেটারহেড দেখিয়ে চাকরির ‘নকল’ পরীক্ষা নেওয়া হয়। অভিযোগ, পরীক্ষার পর সাধু তাঁদের জানিয়েছিল, কয়েক দিনের মধ্যেই নিয়োগপত্র বা নিয়োগকর্তার ফোন পাবেন মোবিনরা। পুলিশ জানিয়েছে, ডিসেম্বর মাসে ফের ওই চার জনকে ডেকে পাঠানো হয়। এ বার তাঁদের কলকাতায় আসতে বলা হয়।
গত ২৬ ডিসেম্বর কলকাতায় পৌঁছন মোবিনরা। পুলিশ সূত্রের খবর, রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয় চার জনকে। শিক্ষাগত যোগ্যতার সব প্রমাণপত্র নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল তাঁদের। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, দুষ্কৃতীদের ছক ঘুণাক্ষরেও টের পাননি রাজস্থানের চার যুবক। কলকাতায় পৌঁছনোর পর সাধু তাঁদের জানিয়েছিল, ৬ জানুয়ারি মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য বর্ধমানে যেতে হবে। চাকরির নিয়োগপত্র মিলবে তার পরই।
পুলিশ সূত্রের খবর, বর্ধমানে পৌঁছনোর পর মোবিনদের একটি লজে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখান থেকে গাড়িতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় প্যামরা গ্রামের একটি নির্মীয়মাণ বাড়িতে। ‘ফাঁদে’ পড়েছেন তা তখনই টের পান রাজস্থানের ওই চার যুবক। পুলিশ জানায়, বর্ধমানে যাওয়ার পরে ওই যুবকদের বেশ কয়েকদিন খোঁজ না-পেয়ে হাওড়ায় মোবিন খানের এক আত্মীয় স্থানীয় পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এর পরেই হাওড়া ও কলকাতা পুলিশ তদন্তে নামে।
এ দিন ভোরে অপহৃতদের উদ্ধারের পরে প্যামরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের এক প্রান্তে পাঁচিল-ঘেরা বাড়িটির অবস্থান। পুলিশ জানায়, বাড়ির মালিক কামেশ্বর সিংহ। কেয়ারটেকার কৃষ্ণ যাদবকেও ধরা হয়েছে। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, উঁচু পাঁচিলের আড়ালে কয়েক জনকে আটকে রাখা হয়েছিল, তা ঘুণাক্ষরেও বোঝা যায়নি। হুগলি-হাওড়ার আরও কয়েকটি ডেরায় এ ভাবে ‘শিকারদের’ আটকে রেখে এই চক্রটি মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে পুলিশের সন্দেহ। |