নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
হিমগিরির বাতানুকূল কামরায় গুলি, হত ঠিকাকর্মী
ধ্যরাতে যাত্রীরা যখন ঘুমে, গুলি চলল সুপারফাস্ট হিমগিরি এক্সপ্রেসের বাতানুকূল কামরায়। রেলে খাবার ও কম্বল দেয় যে ঠিকাদার সংস্থা, গুলিবিদ্ধ হলেন তার দুই কর্মী। ঘটনাস্থলেই এক জনের মৃত্যু হয়। অন্য জন গুরুতর জখম। এই ঘটনায় ফের বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যাত্রী সুরক্ষার প্রশ্নটিও।
শুক্রবার রাতে জম্মু-তাওয়াইগামী হিমগিরি এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে ছেড়ে আসানসোল পৌঁছনোর আগেই ঘটনাটি ঘটে। রেল পুলিশ জানায়, নিহতের নাম সাগর ঠাকুর (৪৮)। শনিবার বিকেলেই আহত গণেশ সাউকে কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আহত গণেশবাবু জানিয়েছেন, কয়েক জনকে দরজার কাছে মদ খেতে বাধা দেওয়ায় তারা গুলি চালায়। যদিও পূর্ব রেল ও রেল পুলিশের কর্তারা ঘটনাটি নিয়ে পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন। ঘটনায় কেউ ধরাও পড়েনি। প্রায় দু’ঘণ্টা খানাতল্লাশির পরে শনিবার ভোর ৫টা নাগাদ ট্রেনটিকে রওনা করিয়ে দেওয়া হয়।
তবে বাতানুকূল কামরায় গুলি চলার ঘটনা রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে গোটা ট্রেনে। কর্মীরাই যেখানে আক্রান্ত, সেখানে যাত্রীদের নিরাপত্তা কতটুকু, উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্নও। সম্প্রতি সব জোনের জেনারেল ম্যানেজারদের রেল বোর্ডে ডেকে পাঠিয়ে যাত্রী নিরাপত্তার বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। তাতে যে পরিস্থিতি বিশেষ পাল্টায়নি, এই ঘটনায় সেটাই ফের স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। যদিও পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামীর মতে, “এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কোন সময়ে কোন ঘটনা ঘটবে, সেটা তো আগে থেকে জানা যায় না।”
চিত্রণ সুমন চৌধুরী
নিয়ম অনুযায়ী, ট্রেনে রেল পুলিশ ও রেল রক্ষী বাহিনীর (আরপিএফ) জওয়ানদের থাকার কথা। হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার মিলনকান্ত দাস জানান, তাঁদের এক এএসআই এবং তিন কনস্টেবল ট্রেনের সামনের দিকে অসংরক্ষিত কামরায় ছিলেন। স্লিপার ক্লাসের নিরাপত্তার দায়িত্বও ছিল তাঁদের। সমীরবাবু জানান, ট্রেনে আরপিএফ জওয়ানরাও ছিলেন। তবে বাতানুকূল কামরায় যে হেতু ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, তাই সেখানে পাহারা রাখা হয় না। এ ক্ষেত্রেও ছিল না।
কী ঘটেছিল শুক্রবার রাতে?
হিমগিরি এক্সপ্রেসের ডেপুটি চিফ ট্রেন ইনস্পেক্টর এস পি সিংহ আসানসোল রেল পুলিশের কাছে জানিয়েছেন, রাত ১১টা ৫০ মিনিট নাগাদ ট্রেনটি হাওড়া থেকে ছেড়েছিল। ঘণ্টা দেড়েক পরে বাতানুকূল এ-১ কামরায় শৌচাগারের পাশে তিনি দু’জনকে পড়ে থাকতে দেখেন। হাওড়া ছাড়ার পরে হিমগিরি এক্সপ্রেস প্রথম দাঁড়ায় আসানসোল স্টেশনে। রাত ৩টে নাগাদ সেখানে পৌঁছলে কয়েক জন যাত্রী ধরাধরি করে জখমদের নামান। রেল পুলিশও চলে আসে। আসানসোল মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সাগরবাবুকে ‘মৃত’ ঘোষণা করা হয়। গণেশবাবুকে কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাতে সেখানেই তাঁর অস্ত্রোপচার হয়।
আসানসোল হাসপাতালে শুয়েই গণেশবাবু অতি কষ্টে অভিযোগ করেন, কয়েক জন রেলযাত্রী শৌচাগারের পাশে দরজার সামনে বসে মদ্যপান করছিল। বেশ কয়েক বার নিষেধ করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। কন্ডাক্টরের আসনে বসে তিনি আর সাগরবাবু রাতের খাওয়া সারেন। তার পরে বাসন রাখতে যেতেই এক জন খেপে উঠে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে। সাগরবাবুর বুকে ও উরুতে গুলি লাগে। গণেশবাবুর পেট ফুঁড়ে গুলি চলে যায় শিরদাঁড়ার কাছে। তাঁরা লুটিয়ে পড়তেই বিপদ বুঝে আততায়ীরা পালায়।
এ দিন সকালে পূর্ব রেলের আসানসোলের ডিআরএম জগদানন্দ ঝা-ও বলেন, “ওই দুই ঠিকাকর্মীর সঙ্গে কয়েক জন রেলযাত্রীর বচসা হয়। তার জেরেই ওই যাত্রীরা দু’জনকে গুলি করে। বৈধ যাত্রীরা, নাকি জোর করে বাতানুকূল কামরায় উঠে পড়া কেউ এই ঘটনায় জড়িত, তা জানা যায়নি।” সকালের এই বক্তব্য কিন্তু দুপুরে দেওয়া ‘প্রেস বিজ্ঞপ্তি’তে বদলে যায়। সেখানে গুলি চলার বিষয়টি কার্যত এড়িয়ে যায় পূর্ব রেল। বরং বলা হয়, যাত্রীরা গুলির শব্দ শুনতে পাননি। কামরার মেঝেয় রক্তের দাগও ছিল না। রেল পুলিশ কামরায় কোনও পিস্তল পায়নি।
হাসপাতালে আহত গণেশ সাউ। ছবি: শৈলেন সরকার
রেল পুলিশ কিন্তু গুলির কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে। হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার মিলনকান্ত দাস জানিয়েছেন, ময়না-তদন্তে মৃতের শরীর থেকে .৩২ বোরের দু’টি গুলি বার করা হয়েছে। তাঁদের অনুমান, কোনও ছোট আগ্নেয়াস্ত্র থেকে এই গুলি ছোড়া হয়েছিল। সুপারের দাবি, কামরার যাত্রীদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, ট্রেনটি দুর্গাপুর পেরনোর পরে ওই দুই কর্মী ট্রেনের কন্ডাক্টরের আসনে বসে খাওয়া-দাওয়া করছিলেন। মাংস-রুটির সঙ্গে ছিল পানীয়ও। দু’জনের কথা কাটাকাটিও হয়। কিছু ক্ষণ পরে ‘ফট’ করে শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু ঘুম চোখে তাঁরা আর উঠে দেখেননি, কীসের শব্দ। রেল পুলিশ সুপার বলেন, “ঠিক কী ঘটেছিল, তা আহতকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেই পরিষ্কার হবে।”
আসানসোলে রেল পুলিশের কাছে গণেশবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি বা সাগরবাবু কেউই গুলি চালাননি। তাঁরা যদি সত্যিই গুলি চালিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেল না কেন, সে প্রশ্নের জবাব এখনও মেলেনি। গণেশবাবুর বাড়ি ব্যারাকপুরের সাধন গাজি রোডে। তাঁরা যে সংস্থার হয়ে কাজ করেন, সেটির অফিস সিঁথির মোড়ের কাছে। সন্ধ্যায় এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁর স্ত্রী ভারতী সাউ পাল্টা বলেন, “মদ-সিগারেট কোনও নেশাই আমার স্বামী করে না। সাগরের সঙ্গে ওর সম্পর্কও খুব ভাল।”
রাতে হাসপাতালে রেলের কোনও কর্মীকেই দেখা যায়নি। গণেশবাবুর অফিস ও পরিবারের লোকেরাই রক্ত-ওষুধ নিয়ে দৌড়দৌড়ি করেছেন। সমীরবাবুর ব্যাখ্যা, “খুনের মামলা হওয়ায় বিষয়টি রেল পুলিশ দেখছে।” তবে ভারতীদেবীর প্রশ্ন, “পিস্তল নিয়ে কামরায় লোক উঠে গেল, অথচ রেল পুলিশ কিছু জানেই না! তা হলে সাধারণ যাত্রীর নিরাপত্তা কোথায়?” রেল পুলিশ সুপারের বক্তব্য, “মাঝে-মধ্যেই আচমকা তল্লাশি চালানো হয়। কী করে পিস্তল নিয়ে লোকে ট্রেনে উঠল, সেটা আমাদেরও চিন্তার বিষয়।” হাওড়া রেল পুলিশের ডেপুটি সুপার ধীমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “টহলরত আরপিএফ, জিআরপি ও অন্য রেলকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.