সেজে গুজে খুশ, নয়া পৌরুষ
ছেলেরা যেন বানের জলে ভেসে এসেছে! পার্লারে গিয়ে চুল সেট করলে, পেডিকিয়োর করলেই রে রে হইহই। কেউ বলবে, ন্যাকা। কেউ বা মেয়েলি! কেন রে বাপু, ছেলেরা কি আয়না দেখে না? নাকি, তাদের একটু ফিটফাট থাকতে ইচ্ছা করে না?
ছেলেদের সাজুগুজু করাকে যাঁরা ‘ন্যাকামি’ বলেন, একটা গল্প জেনে রাখুন। শ্রীপান্থ এক বার নীরদচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। নীরদবাবু খুব ব্যস্ত, ডিনারে যেতে হবে। তার পর শ্রীপান্থের বর্ণনা, ‘একটা খাটের উপর সাজানো রয়েছে ডিনারের পোশাক। আন্ডারওয়ার থেকে কোট, রুমাল কিছু বাদ নেই।... স্ফূর্তিতে বালকের মতো কাণ্ডকারখানা। দু’হাতে বুকে ধরে হাজির করলেন গুচ্ছের শিশি-বোতল-কৌটো। প্রসাধনী। বললেন, হ্যাঁ, এগুলো আমার। আমিই সব ব্যবহার করব। আমার স্ত্রীর জন্য রয়েছে অন্য সেট। সবই বিলিতি।’
কোন পুরুষ না চায় ত্বকের যত্ন নিতে? নীরদচন্দ্র ডিনারে যাওয়ার আগে প্রসাধনী মাখতেন। আর মহাত্মা গাঁধী? ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, গাঁধী ছুটে গিয়েছেন নোয়াখালি। ৭৭ বছর বয়স, রোজই সেখানে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে হেঁটে যান। হিন্দু মুসলিম দুই পক্ষকে নিয়ে শান্তিকমিটি গঠন করেন। কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যেও দেড় ঘন্টার মাসাজ এবং স্নানের রুটিনটি অটুট। স্নানের আগে এক আউন্স সর্ষের তেলে এক আউন্স লেবুর রস দিয়ে মাসাজ।
হাতের কাছে এত উদাহরণ, তবু সংখ্যাগরিষ্ঠের মানসিকতা বদলায় না। সাবেক ‘পিতৃতন্ত্র’ মাথায় হাতুড়ি মেরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, ছেলেরা হবে বোহেমিয়ান, রাফ অ্যান্ড টাফ। জীবনের রেসকোর্সে সে শুধু নাকে দড়ি দিয়ে ছুটবে। রূপচর্চা? দূর, ও সব ‘মেয়েলি’ ব্যাপার। ছেলেরা বাইরে ‘জীবনযুদ্ধ’ লড়বে। কখনও জিতবে, কখনও বা ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে। আর মেয়েরা সেই রণক্লান্ত ছেলেদের জন্য ‘শান্তির আশ্বাস’ নিয়ে থাকে শুধু মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
সেই পিতৃতান্ত্রিক বয়ানকেই সারা দুনিয়া জুড়ে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে আজকের নতুন পুরুষ। একটা ব্যবসায়িক পরিসংখ্যান দিই। আশির দশকে নিউ ইয়র্কের সুপারমার্কেটগুলিতে মেরেকেটে ২৫ শতাংশ পুরুষ নিজেদের জামাকাপড় কিনতে যেতেন। মহিলারাই তখন পুরুষদের হয়ে বেশির ভাগ কেনাকাটা সারতেন। ২০০৪ সাল নাগাদ দেখা দেল, পরিসংখ্যান উল্টে গিয়েছে। ৭০ শতাংশ পুরুষই এখন নিজের জামাকাপড় কিনতে আসেন।
ট্রেন্ডটা পাল্টে গেল কেন? কারণ, ‘পৌরুষ’-এর প্রথাসিদ্ধ সংজ্ঞাটা বদলে গিয়েছে। প্রথাসিদ্ধ পৌরুষের লক্ষণ কেমন?
১) মেয়েলি ভাব এড়িয়ে যাওয়া,
২) আবেগপ্রকাশে আতিশয্য নয়,
৩) যৌনতা এবং ‘ইন্টিমেসি’ আলাদা করা,
৪) সামাজিক মর্যাদা ও নানাবিধ অ্যাচিভমেন্টের জন্য দৌড়,
৫) আত্মনির্ভরশীলতা,
৬) শারীরিক শক্তি ও আগ্রাসী মনোভাব।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ, প্যারিসে ছাত্রবিক্ষোভ, নারী আন্দোলন ও সমকামী স্বীকৃতি ‘পৌরুষ’-এর এই বেলুনটি চুপসে দেয়। কে বলল, কান্না মানে মেয়েলি আবেগের আতিশয্য? সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ট্যাঙ্ক হাঙ্গেরির রাস্তায় কয়েকশো ছাত্রকে কোতল করার পরেও চোখে জল আনা যাবে না? শারীরিক শক্তি, আগ্রাসী মনোভাব তো নারী-পুরুষ বিভাজনের উর্ধ্বে ক্লীব ‘রাষ্ট্রশক্তি’র লক্ষণ। মর্যাদা? অ্যাচিভমেন্ট? তার আগে কলেজ থেকে বেরিয়ে রাজপথে জড়ো হয়ে ভিয়েনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ জরুরি। ঘনিষ্ঠতা আর যৌনতা আলাদা? সেটাই ‘সেক্সুয়াল পলিটিক্স’।
সমাজ বদলাচ্ছে, এ দিকে ‘কনজিউমারিজম’-এর দাপটে পুরুষের জন্যও হরেক ক্রিম আর বডি লোশন। পুরুষের শরীরচিহ্ন বদলানোর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সত্তর দশকে অমিতাভ বচ্চন ‘দিওয়ার’ ছবিতে পারভিন বাবির পাশে শুয়ে সিগারেট টানছেন, প্রশস্ত ও রোমশ বক্ষদেশ। পুরুষের বুকে লোম তখন ‘সেক্সি’। নব্বইয়ের দশকের পর সলমন, শাহরুখরা এই ধারণা বদলে দেবেন। তাঁরা প্রতিনিয়ত বুকের লোম ‘ওয়াক্সিং’ করেন, ‘টুইজার’ ব্যবহার করেন, নায়িকার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদেন। বিদেশে ডেভিড বেকহ্যাম চমৎকার ফুটবল খেলেন, কিন্তু বাড়িতে বাচ্চা সামলান, স্ত্রী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে সমান গ্ল্যামারাস সাজে বিভিন্ন পার্টিতে হাজির হন। ‘পশ স্পাইস’-এর গ্ল্যামার হয়তো কিঞ্চিৎ বেশি, কিন্তু বেকহ্যাম তাতে দমবেন না। মেট্রোসেক্সুয়াল পুরুষ!
একুশ শতকে এই মেট্রোসেক্সুয়াল পুরুষের দিনশেষে এসে গিয়েছে নতুন দিনের ‘উবেরসেক্সুয়াল পুরুষ’। জার্মান ‘উবের’ কথাটার মানে, ওপরে। মানে, এই ‘উবেরসেক্সুয়াল’রা পুরুষেরও ওপরে আরও কিছু। মেট্রেসেক্সুয়াল পুরুষ টুইজার ব্যবহার করে, ক্রিম মেখে আর নিজের ম্যাচিং পোশাক কিনে, নায়িকার ঘাড়ে মাথা রেখে কেঁদে খালাস। উবেরসেক্সুয়াল-এর দায়িত্ব আর একটু বেশি। সে এই সব সাজুগুজু, কান্নার ‘মেয়েলি আবেগ’ বিসর্জন দেবে না। কিন্তু ইন্টেলেক্ট, প্যাশন, পেশাদারি সাফল্য, এগুলিকেও সমান গুরুত্ব দেবে। ২০০৫ সালে দ্য ‘ফিউচার অব মেন’ বইয়ে উবেরসেক্সুয়াল পুরুষের ব্যাপক প্রশংসা করে লেখা হয়েছিল, ‘an evolved species of man....so perfect as to leave little margin for error and falacy।’ একেবারে চাহিদামাফিক, উন্নততর পুরুষ!
পিতৃতন্ত্র এ ভাবেই নিজেকে টিকিয়ে রাখে। সংঘাত আর সমন্বয়। ‘মেট্রোসেক্সুয়াল পুরুষ’ ক্ষমতার সঙ্গে সংঘর্ষে গিয়েছিল। কেনই বা কাঁদব না? কেনই বা সাজব না? তার পরই ‘উবেরসেক্সুয়াল’-এর আবির্ভাব। বেশ, কাঁদো, সাজুগুজু করো। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তি, প্যাশন, পেশাদারি সাফল্য এগুলি ভুলে যেও না। ‘ক্ষমতা’র নিয়মই এই। সংঘাত আর সমন্বয়ের মাধ্যমে সে আধিপত্য টিকিয়ে রাখে।
সে রাখুক। কিন্তু সত্য অন্যত্র। ক্ষমতা জানে, ‘মেট্রোসেক্সুয়াল’, ‘উবেরসেক্সুয়াল’ যাই হোক, পুরুষেরা ক্লেনজিং মিল্ক, টুইজার, ক্রিম, নেলপালিশ ব্যবহার করবেই। তা হলে আর ছেলেদের পার্লারে যাওয়ার উৎসব বাকি থাকে কেন?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.