রাজ্য-রাজনীতির পট-পরিবর্তনের আট মাস পরে, এ বার রাজ্য সরকারের বিরোধিতায় আটঘাট বেঁধে মাঠে নামার ইঙ্গিত দিল সিপিএম তথা বিরোধী-শিবির।
আর খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই যে তাঁর ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কাজ ও মন্তব্যে তাঁদের আন্দোলনে নামার সুযোগ করে দিচ্ছেন, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র। মৌলালি যুবকেন্দ্রে শুক্রবার বামফ্রন্টের চার শরিক দলের ছাত্র সংগঠনের কনভেনশনে রাজ্য সরকারের নতুন বিশ্ববিদ্যালয় বিল প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। জানুয়ারি মাস জুড়ে গোটা রাজ্যে বিক্ষোভের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বাম ছাত্রদের কনভেনশনে দক্ষিণবঙ্গের ১৩টি জেলার প্রতিনিধিরা কলকাতায় এসেছিলেন। এ বার উত্তরবঙ্গের ৬টি জেলার প্রতিনিধিদের নিয়েও এমন সম্মেলন করার কথা ভাবছে ছাত্র সংগঠনগুলি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইন নিয়ে জেলায় জেলায় আন্দোলনের পরে ফেব্রুয়ারি মাসে বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর দফতরে ঘেরাও-কর্মসূচিও এ দিন ঘোষিত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে বিরোধী-আন্দোলনের এই ঝাঁঝ শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে অন্যত্র কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই এখন দেখার।
সেই মঞ্চ থেকেই সূর্যবাবু মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে রীতিমতো ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে বলেছেন, “আপনি মুখ খুললেই আমায় মুখ খুলতে হচ্ছে! মুখ্যমন্ত্রী আমাদের ১০ বছর চুপ করে থাকতে বলেছেন। কিন্তু উনি যা বলছেন, তাতে ১০ সেকেন্ডও চুপ থাকতে পারছি না!”
প্রসঙ্গত, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম এর আগে মমতাকে ‘হিটলারের নাতনি’ বলে কটাক্ষ করায় বামফ্রন্টের অন্দরেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু সামগ্রিক ভাবেই বিরোধী শিবিরের সুর যে এ বার চড়বে, সূর্যবাবুর এ দিনের বক্তব্যে তার ইঙ্গিত রয়েছে।
সাধারণত, বামেরা কোনও সমালোচনা করলেই মমতা গত ৩৪ বছরের ‘ব্যর্থতা’র অভিযোগ তুলে তাদের নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। মুখ্যমন্ত্রী এ দিনও তাঁর সমালোচকদের পাল্টা সমালোচনা অব্যাহত রেখেছেন। বৃহস্পতিবারের মতো চড়া সুরে না-হলেও এ দিন দিঘায় সৈকত উৎসবে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ফের তাঁর সমালোচকদের আক্রমণ করতে ছাড়েননি। |
বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু গত ৩৪ বছরের পরিস্থিতির থেকেও ‘অবক্ষয়ে’র আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সূর্যবাবু বলেন, “আমাদের আমলে দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রীয় সংস্থা উৎকর্ষের জন্য ‘এ প্লাস’ গ্রেড দিয়েছিল। এর থেকে বেশি কিছু তো পাবেন না। দেখবেন, গ্রেডটা যেন ‘বি-মাইনাস’ না হয়ে যায়!” মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশেই বাম জমানার মন্ত্রী তথা বর্তমান বিরোধী দলনেতার আরও সতর্কবাণী, “৩৪ বছরে আমরা যেটুকু করেছি, সেটুকু অন্তত রক্ষা করুন! দেখবেন, রাজ্যকে তার থেকে পিছিয়ে দেবেন না।”
বস্তুত, সরকার ‘ভুল’ করলে তাঁরা চুপ করে থাকবেন না বলে সিপিএমের জেলা সম্মেলনগুলিতে ইদানীং সরব বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুরা। তবে দলের ভিতরে-বাইরে ‘মিতভাষী’ বলে পরিচিত সূর্যবাবুর বক্তৃতায় এমন ‘আক্রমণাত্মক ভঙ্গি’ কিছুটা ব্যতিক্রমী। বাম শিবিরের একাংশের মতে, ছাত্র-ছাত্রী তথা তরুণ প্রজন্মের সভা বলেই তাদের ‘তাতাতে’ বিরোধী দলনেতা কিছু ‘চোখা সংলাপ’ প্রয়োগ করে থাকতে পারেন। বিরোধী দলনেতা হিসাবে সূর্যবাবু সাধারণত মমতার নাম উল্লেখ করে কিছু বলেন না। সে কথা জানিয়েই এ দিন তিনি বলেছেন, রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হিসাবে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ যা করছেন, তারই জবাব দিতে হচ্ছে তাঁদের। একই সঙ্গে সিপিএম বুঝিয়ে দিয়েছে, সরকার পক্ষের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে
প্রাথমিক ভাবে ‘অস্ত্র’ হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রের ‘বিশৃঙ্খলা’ এবং নয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনকেই ব্যবহার করতে চাইছে তারা।
রায়গঞ্জে অধ্যক্ষ নিগ্রহকে মমতা যে ‘ছোট্ট ঘটনা’ আখ্যা দিয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ টেনেও সূর্যবাবু এ দিন মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছেন। তাঁর কথায়, “অনেকে বলেন, এ রাজ্যে এখন একটাই পোস্ট (মুখ্যমন্ত্রী) বাকিরা (অন্য মন্ত্রীরা) ল্যাম্পপোস্ট। আমিও বলি, এক জনই মন্ত্রী, বাকিরা সান্ত্রী! বাকিদের দোষ দিই না। মাথা এমন হলে তাঁরা আর কী করবেন?” শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্বিক ‘অশান্তি’র পটভূমিতে তাঁর কটাক্ষ, “শিল্পপতিদের ডেকে বলা হচ্ছে, ‘বেঙ্গল লিড্স’। বাস্তবে বাংলা রায়গঞ্জ, রামপুরহাটে লজ্জার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে!”
ছাত্র সম্মেলন মঞ্চে স্কুল-কলেজে ‘অশান্তি’ বা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সমালোচনা প্রত্যাশিতই। যেমন প্রত্যাশিত যে, তাঁর বক্তব্যে মাজদিয়া কলেজে এসএফআইয়ের ছাত্রদের হাতে অধ্যক্ষ-নিগ্রহ প্রসঙ্গ বিরোধী দলনেতার এড়িয়ে-যাওয়া। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সমালোচনায় এ দিন তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ ‘গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব’, জোট-শরিক কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের ‘তিক্ততা’ বা মাওবাদীদের সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ নিয়েও সূর্যবাবু মুখ খুলেছেন। ঝাড়গ্রামে জঙ্গলমহল উৎসবের মঞ্চে রাজ্যের পদস্থ আমলাদের ডেকে ডেকে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে কাজের ‘খতিয়ান’ দিইয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সূর্যবাবু বলেন, “আগে শিল্পপতিদেরও রোল কলের ভঙ্গিতে প্রকাশ্য সভায় ডাকাডাকি করা হয়েছিল। এটা ক্লাস!” তাঁর অভিযোগ, এক দিন আগে মহাকরণে বিবেকানন্দের জন্মদিন-পালন থেকে নতুন নতুন অর্ডিন্যান্স জারির পদ্ধতি, সব কিছুতে মুখ্যমন্ত্রীর ‘আত্মম্ভরিতা’ প্রকাশ পাচ্ছে।
শাসক-বিরোধী শিবিরের মধ্যে ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’ যে অন্তর্হিত হচ্ছে, তার লক্ষণ এখনই স্পষ্ট! |