প্রতি পক্ষ
স্বপ্নটি আন্তর্জাতিক
স্বপ্ন মানে ঠিক কী? যত মত তত পথ, নিঃসন্দেহে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড এক রকম ব্যাখ্যা দেবেন। অভিধান একটা কথা বলবে। দু’হাজার বারো, ৬ জানুয়ারির কলকাতা অন্য রকম একটা ছবি দেখাল। স্বপ্নের ছবি। সেই ছবি উড়াল দিল না, এখনই হয়তো ঠিক জন-পরিসরে বলা যাবে না, কিন্তু মানসপটে তো বটেই। এবং, সেই সূত্রে স্বপ্নটি, বা স্বপ্নগুলি সাকার হওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেল। সৌজন্য, নির্মীয়মাণ কলকাতা মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্ট, সংক্ষেপে ‘কেমোমা’।
তথ্যের খাতিরে আরও একটু ভেঙে বলাই ভাল। ‘কেমোমা’-র অ্যাকাডেমিক উইং-এর অধিবেশন। রুদ্ধদ্বার ঠিকই, কিন্তু অন্য পাঁচটা সভা-সমিতির সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেললে মুশকিল। কারণ, এখানেই উড়াল দিচ্ছে সেই স্বপ্ন। তার শরিক যাঁরা, তাঁরা আন্তর্জাতিক বিদ্বৎ সমাজে স্বীকৃত। যেমন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা এবং মানবিকী বিদ্যা বিভাগের ডিন ডিয়ানা সোরেনসন। যেমন, কোর্তুল ইনস্টিটিউট অব আর্ট-এর ডিরেক্টর ডেবোরা সোয়ালো। যেমন, সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ইতিহাস বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক পার্থ মিত্র, যিনি বিদ্বৎ-মহলে ‘পার্থ মিটার’ নামেই সমধিক পরিচিত। আছেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল মিউজিয়ম এবং সিঙ্গাপুর আর্ট গ্যালারির অধিকর্তা কোয়াক কিয়ান চাও। আছেন বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ম ও নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ফ্র্যাঙ্ক জে করম। আছেন শিল্পবেত্তা জঁ ফ্রঁসোয়া শেভরিয়ের। বা, ভারতশিল্পের সুখ্যাত বিশেষজ্ঞ অশোককুমার দাস।
‘কেমোমা’-র ‘অ্যাকাডেমিক উইং’-এর অধিবেশন
অর্থাৎ, শিল্প নিয়ে, এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে যাঁদের পঠনপাঠন এবং ভাবনার অধিকার বিশ্বময় বন্দিত, তাঁরাই এগিয়ে এসেছেন সেই স্বপ্নের রূপায়ণে। ‘মিউজিয়ম’ মানে কি শুধুই নিষ্প্রাণ সংগ্রহশালা? শুধুই অতীতের বিষণ্ণ, দম-চাপা ঘ্রাণ? যেন এক ধরনের ‘জুরাসিক পার্ক’ হওয়াটাই মিউজিয়ম-এর একমাত্র নিয়তি? অথচ, মিউজিয়ম বা সংগ্রহশালা কি সেই জায়গাও নয় যাকে ঘিরে চলতে থাকবে শিল্প-সংক্রান্ত নানা রকম কাজকর্ম? খুব জীবন্ত ভাবেই চলবে। বিদ্যাচর্চারও কেন্দ্র হয়ে উঠবে সেই পরিসর। আন্তর্জাতিক আঙ্গিক সে রকমই দাবি করে। কান উৎসব বা বঙ্গীয় জনতা দেখার ঢের আগে ‘পথের পাঁচালি’ প্রথম দেখে নেয় বিদেশের এক মিউজিয়ম। নিউ ইয়র্ক-এর মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্ট, নামসংক্ষেপে ‘মোমা’। কলকাতা সফরের সময় ছবির ‘রাশ’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘মোমা’-র প্রদর্শনী এবং প্রকাশন বিভাগের অধিকর্তা মনরো হুইলার। তিনিই সত্যজিৎ রায়কে উৎসাহ দেন, সময়মতো শেষ হলে পরের বছর ‘মোমা’-র প্রদর্শনীতে থাকতে পারে এই ছবি। কী ভাবে ছবিটি শেষ পর্যন্ত ‘মোমা’-য় গিয়েছিল, সেই আখ্যান আজ ইতিহাস। বহুচর্চিত, তাই পুনরুল্লেখ অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু, এই ঘটনাটি দিগদর্শীও বটে। দেখিয়ে দেয়, সমকালীন শিল্পকলার কোনও সংগ্রহশালার ভূমিকা আন্তর্জাতিক স্তরে ঠিক কী রকম হতে পারে। উল্লেখ থাক, ‘কেমোমা’ শুধু নামেই সেই আন্তর্জাতিক রীতিটি মান্য করতে চায়নি, এই প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচির মধ্যেও সেই আদ্যন্ত পেশাদার এবং সমকালীন ছাপ।
তাই, ‘কেমোমা’-র ‘অ্যাকাডেমিক উইং’-এর সেই অধিবেশনের সঙ্গে থাকে একটি প্যানেল। ভাবনা বিনিময়ের কার্যক্রম। আঠারো শতকের শেষ থেকে একেবারে সমসময়, এই কালপর্বের ভিতর ভারতশিল্পের একটি আখ্যান কী ভাবে গড়া যেতে পারে। অলকা পাণ্ডে, পারুল দাভে মুখোপাধ্যায়, নমন পি আহুজা, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায় বা তপতী গুহঠাকুরতার মতো বিশেষজ্ঞেরা মত বিনিময় করলেন। থাকলেন যোগেন চৌধুরী। মেধাবী সংলাপে উঠে এল তত্ত্বের নানা দিগন্ত। একই সঙ্গে, বাস্তবের ছবিটাও ভাসল বারংবার।
রামকিঙ্করের ‘সাঁওতাল পরিবার’
একমুঠো শব্দে বেশ কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সেই সংলাপের সারাৎসারটুকুও বর্ণনা করা কঠিন, কারণ একাধিক বার খাত বদলেছে প্রসঙ্গ, গিয়ে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে ফের খুলে গিয়েছে অন্য কোনও ভাবনার ইশারা। নিট ফল, তত্ত্ব এবং তথ্যের একটি আশ্চর্য সংশ্লেষ। পারুল দাভে যদি ইতিহাসকে স্থাপন করতে চান ভূগোলের স্থানাঙ্কে, বলেন আধুনিকতা কবে, এই প্রশ্নের পাশাপাশি আমরা তো এও ভাবতে পারি, আধুনিকতা কোথায়, তা হলে নমন আহুজা প্রশ্ন তোলেন ‘শিল্পী’ এবং ‘কারিগর’, এই দুটো অভিধা প্রয়োজনবোধে একসঙ্গেই বা জুড়ে থাকবে না কেন? ও পার থেকে অলকা উসকে দেন বিতর্ক, অনেক শিল্পীই তো স্রেফ নকশাটুকু করে ছেড়ে দেন, বাকি কাজটা অনামা কারিগররাই করেন। তপতী গুহঠাকুরতা স্বভাবসিদ্ধ শান্ত ভঙ্গিতে মনে করিয়ে দেন, নকল ছবির আখড়া হয়ে উঠছে এই শহর। পাশাপাশি, যে সব দুর্লভ শিল্পবস্তুর সংগ্রহ মহানগরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কার্যত বন্দিদশায় পড়ে আছে, জনতার সেখানে কোনও দর্শনের অধিকার নেই, সেই জরুরি বিষয়টিও উঠে আসে তাঁর কথায়। ‘কেমোমা’-র ম্যানেজিং ট্রাস্টি রাখী সরকার এক ফাঁকে জানিয়ে দেন, ‘কেমোমা’ এখনও মাত্রই হয়ে ওঠার পথে, কিন্তু এরই মধ্যে সেখানে শিল্পবস্তুর পুনরুদ্ধার, অর্থাৎ ‘রেস্টোরেশন’-এর অজস্র অনুরোধ আসছে। ভবিষ্যতে এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে পেশাদারি দক্ষতা নির্মাণের ব্যাপারে ‘কেমোমা’-র ভূমিকার কথা উঠে আসে তাঁর সংক্ষিপ্ত, মূল্যবান প্রতিক্রিয়ায়।
তাত্ত্বিক চর্চা তো বটেই, কিন্তু একেবারে ঘটমান বর্তমানেও জুড়ে থাকে এই সব সংলাপ। যোগেন চৌধুরী সখেদে বলেন, রামকিঙ্করের মতো শান্তিনিকেতনের অনেক মান্য শিল্পীর কাজই শান্তিনিকেতনে ধরে রাখা যায়নি। অন্য রাজ্যে চলে গিয়েছে সে সব। এই সূত্রে জেগে ওঠে অন্য একটি বিতর্ক। শিল্পী যেখানে কাজ করছেন, সেখানে যদি তাঁর কাজ না-ই থাকে, তাতেই বা কী? এই ভাবে স্থান, কাল আর পাত্রকে জড়িয়ে গড়ে ওঠে ভাবনার বহুমাত্রিক ভাস্কর্য।
ভাবনা, নাকি একটি স্বপ্ন? খাস কলকাতার বুকে গড়ে উঠতে থাকা একটি সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বপ্ন।
কলকাতা মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্ট, সংক্ষেপে ‘কেমোমা’।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.