সরকারের বিভিন্ন দফতরের যে পরিষেবা জনসাধারণকে দেওয়ার কথা, প্রায়শই তাহা দিতে আমলাতন্ত্রের তরফে গড়িমসি লক্ষ করা যায়। সরকারেরই কোনও বকেয়া কাজ লইয়া দফতরে তাগাদা দিতে গেলেও প্রায়শ তাগাদাকারীদের খেদাইয়া দেওয়া হয়। অথবা, বিভিন্ন অজুহাতে কাটাইয়া দেওয়ার চেষ্টা চলে। নিট ফল, সরকারি দফতরে ফাইল না-নড়া, কাজ না-হওয়া, অন্তত সময়ে কাজ না-হওয়া। শুধু মানবসম্পদের সমূহ অপচয় নহে, এই মন্থরতা, গতিহীনতা, সমগ্র সরকারি প্রশাসনে একটা গয়ং-গচ্ছ মনোভাব আমদানি করিয়া ফেলে। দুর্নীতি তথা আর্থিক অনিয়মও সেই রন্ধ্রপথেই প্রবেশ করে। কেননা সময়ে কাজ করিয়া দিবার জন্য গ্রাহক-উপভোক্তারা তখন উৎকোচ দিতেও প্রস্তুত থাকেন। কেন্দ্রের একটি সিদ্ধান্ত এই মনোভাবের প্রতিকার করিতে পারে নাগরিক বা উপভোক্তাদের সনদ।
এই সনদ চালু হইলে আম জনতা বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা পাওয়ার একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা জানিতে পারিবে এবং সেই সীমার মধ্যে পরিষেবা বুঝাইয়া দিবার জন্য দফতরিদের উপর চাপ সৃষ্টিও করিতে পারিবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সচিবালয় প্রতিটি মন্ত্রকের সহিত এই সনদ চালু করার বিষয়ে আলোচনা চালাইতেছে। মন্ত্রকগুলি সনদ চালু করিতে সম্মত হইবে কি না, তাহার উপরই নির্ভর করিবে আম জনতার সরকারি পরিষেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, দূষণমুক্ত পানীয় জল, ভেজালমুক্ত খাদ্যসামগ্রী সরকারের কাছে জনসাধারণের প্রাপ্য, যেমন প্রাপ্য সময়ানুবর্তী ট্রেন-চলাচল, নিরাপদ ও সময়নিষ্ঠ ভ্রমণের উপযোগী সরকারি পরিবহণ। যথাসময়ে সড়ক, সেতুর নির্মাণ সাঙ্গ করাও সরকারি কর্তব্য। এগুলির কোনওটিই কিন্তু ঠিকঠাক হয় না। দীর্ঘসূত্রতা যদি এক কারণ হয়, অন্য গুরুতর কারণ তবে ঔদাসীন্য এবং দায়সারা মনোভাব। নাগরিক সনদে সজ্জিত হইয়া উপভোক্তারা সরকারি মন্ত্রক বা দফতরের কাছে কৈফিয়ত চাহিতে পারিবেন, সরকারি আধিকারিক, আমলা, এমনকী মন্ত্রীদের উপরেও চাপ দিতে পারিবেন। সরকারি পরিষেবা পাওয়া যে তাঁহাদের অধিকার, সরকারি দফতরের দাক্ষিণ্যসাপেক্ষ দয়ার দান নয়, নাগরিক সনদ তাঁহাদের সেই সচেতনতাও দিবে।
এক হিসাবে এই নাগরিক সনদ তথ্যের অধিকার আইনের মতোই একটি রক্ষাকবচ, যাহা জনসাধারণকে অধিকারসচেতন করিয়া দুর্নীতিপরায়ণ ও ফাঁকিবাজ আমলাতন্ত্রের স্বেচ্ছাচার হইতে সুরক্ষিত রাখে। এই আইন পাশ হওয়ার পর বিভিন্ন রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরের ক্ষেত্রেও সরকারের উপর আম জনতার নজরদারি আগের তুলনায় অনেক বাড়িয়াছে। জন লোকপাল বিল লইয়া নাগরিক সমাজের আন্দোলন এবং তাহার চাপে দীর্ঘ ছয় দশক ধরিয়া ঝুলাইয়া রাখা দুর্নীতি-দমনের একটি বন্দোবস্তকে আইনি, এমনকী সাংবিধানিক অনুমোদন দিতে সরকার উদ্যোগী হইয়াছে। ইহারই পাশাপাশি নাগরিক/উপভোক্তা সনদ বিভিন্ন মন্ত্রক ও সরকারি দফতরে চালু করার ধারণাটি প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করিয়া তোলার প্রয়াসে সামগ্রিকতা দিবে। নাগরিকরা সজাগ ও সচেতন না থাকিলে গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও মরিচা পড়িতে থাকে। তাহার সুযোগে কায়েমি স্বার্থচক্রীরা সরকারি তহবিল ও পরিষেবায় অন্তর্ঘাত করিয়া প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থাটির মর্মেই আঘাত করে। তাই যত বেশি রক্ষাকবচে ব্যবস্থাটিকে মুড়িয়া রাখা যায়, ততই মঙ্গল। |