গুঞ্জনটা ছিল গত কিছু দিন ধরেই। সংশয় তৈরি হয়েছিল খোদ রেল মন্ত্রকেও। সেই জল্পনাকেই আজ আরও উস্কে দিয়ে রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বললেন, “কত দিন রেলমন্ত্রী থাকব, আমি নিজেই জানি না!”
আচমকা এই মন্তব্যের কারণ কী, রেলমন্ত্রী অবশ্য তা ব্যাখ্যা করেননি। কিন্তু জল্পনাকে পুরোদস্তুর উস্কে দিতে এটুকুই যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে এমন সময়ে দীনেশ মন্তব্যটি করেছেন, যখন রেল বাজেট ঘোষণার মাত্র দু’মাস বাকি। এখন তাই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি রেল বাজেট ঘোষণার পরেই ‘ছুটি’ হয়ে যাচ্ছে দীনেশের? নাকি সর্বসমক্ষে এমন একটি মন্তব্য করে সহানুভূতি কুড়োতে চাইছেন তিনি? বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছেন ‘ঠিক জায়গায়’! কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে যে বিবাদ শুরু হয়েছে, সেই ঘটনাপ্রবাহ দেখেই রেলমন্ত্রী এই মন্তব্য করেছেন কি না, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে।
রেল বাজেট প্রস্তুতির প্রক্রিয়া এখন সপ্তমে। এ ব্যাপারে দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন দীনেশ। তার পর আজ ভারতে বুলেট ট্রেন চালানোর সম্ভাবনা নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন রেল মন্ত্রক ও জাপানের প্রতিনিধিরা। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও ওই বৈঠকে দীনেশ জাপানের পরিবহণ ও পরিকাঠামো মন্ত্রী তাকেশি মেডাকে আশ্বস্ত করে বলেন, “পরবর্তী সময়ে যিনিই রেলমন্ত্রী হোন না কেন, সকলেরই উচিত রেলের জাতীয় নীতি অনুসারে ভারতীয় রেলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। জাতীয় নীতি তৈরির বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছে রেল মন্ত্রক।”
প্রশ্ন হল, রেলমন্ত্রী হঠাৎ এমন কথা বললেন কেন?
অনেকেই মনে করছেন, রেলের ভাড়া বাড়ানো নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোভাবে হতাশ রেলমন্ত্রী। আট বছর ধরে রেলের ভাড়া বাড়েনি। অথচ বিমান থেকে সড়ক, পরিবহণের অন্য সব ক্ষেত্রেই ভাড়া বা মাসুল বেড়েছে। রেলের যা আর্থিক হাল, তাতে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। টাকার অভাবে যাত্রী সুরক্ষার দিকটিতে ভাল ভাবে নজর দেওয়া যাচ্ছে না বলেও অনেক মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। এ সব ভাল ভাবেই জানেন দীনেশ। একাধিকবার তিনি এই নিয়ে মুখও খুলেছেন। পণ্য মাসুল বাড়িয়ে তিনি এক সময় যাত্রী ভাড়া, বিশেষত উচ্চ শ্রেণির ভাড়া বাড়ানোর ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, অর্থ মন্ত্রক ও যোজনা কমিশন থেকে এই নিয়ে সঙ্গত কারণেই সমানে চাপ আসছে। কিন্তু যাত্রী ভাড়া বাড়ানো নিয়ে মমতার আপত্তি রয়েছে। রেলমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁর কাছে একাধিকবার অনুমতি চেয়েও বিফল হয়েছেন দীনেশ। যাত্রী টিকিটের দামের ৩০ শতাংশ হল জ্বালানি সংক্রান্ত খরচ। দীনেশ শেষ বার মমতাকে অনুরোধ করেছিলেন, এই অংশটি অন্তত বাড়ানোর অনুমতি দিন। মমতা তাতেও রাজি হননি। তাই অনেকেই মনে করছেন, দলীয় নীতির সঙ্গে সংঘাত বাধায় অসহায় দীনেশ আজ হতাশা থেকেই এই ভাবে নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন।
অন্য জল্পনাও অবশ্য আছে। দিল্লির রাজনৈতিক অলিন্দে একাংশের ধারণা, সম্প্রতি কংগ্রেস-তৃণমূল সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। কংগ্রেস তলে তলে শরিক খুঁজছে। সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে যদি তাদের শেষ পর্যন্ত রফা হয়ে যায়, তা হলে ইউপিএ-তে তৃণমূলের গুরুত্ব কমবে। উত্তরপ্রদেশের ভোটের পরেই সেই ছবিটা স্পষ্ট হবে। তখন তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আর সরকারের সঙ্গে যদি তৃণমূলের সম্পর্ক ছিন্নই হয়ে যায়, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই রেলমন্ত্রিত্ব হারাবেন দীনেশ।
এক দলের তাই বক্তব্য, হতে পারে রেলমন্ত্রী সে কথা মাথায় রেখেই এই মন্তব্য করেছেন।
আবার রেল মন্ত্রকের একাংশের মতে, দীনেশের মন্তব্যের মধ্যে অযথা রাজনীতি খোঁজা উচিত নয়। দীনেশ ওই মন্তব্যটি করেছেন ভারতে বুলেট ট্রেন চালানোর সম্ভাবনা নিয়ে বৈঠকে। ভারতে দ্রুতগামী ট্রেন চালানোর বিষয়টি খরচসাপেক্ষ। তাই তিনি চান, এ বিষয়ে কেন্দ্র একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিক। যাতে রেলমন্ত্রী পরিবর্তন হলেও মন্ত্রীরা ওই নীতি মেনে চলতে বাধ্য হন। দীনেশের বক্তব্য, “রেলের ক্ষেত্রে একটি জাতীয় নীতি রচনা হওয়া প্রয়োজন। যা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে আগামী রেলমন্ত্রীরা।”
মন্ত্রক মনে করছে, স্বাস্থ্য, সর্বশিক্ষা কিংবা সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের যেমন একটি সুনির্দিষ্ট দিশা নির্দেশ রয়েছে, তেমনি রেলের একটি নীতি তৈরি করা হোক। দীনেশের কথায়, “রেল মন্ত্রককে রাজনীতির জাল থেকে মুক্ত করা উচিত। তা হলেও সঠিক পথে এগোতে পারবে রেল। বর্তমানে রেলের যা অবস্থা, তাতে পরিকাঠামো-সহ সব ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়াতে হবে আমাদের।” পাশাপাশি, আজকের বৈঠকে দীনেশ রেলকর্তাদের নির্দেশ দেন, কলকাতা থেকে দিল্লির মধ্যে দ্রুত গতির ট্রেন চালানো সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখতে। ওই প্রকল্প লাভজনক হবে কি না, তা খতিয়ে দেখেই ওই প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রক। এই বক্তব্যকে হাতিয়ার করেই মন্ত্রকের একাংশের মতে, রাজনৈতিক বার্তা নয়। আসলে রেলের দীর্ঘমেয়াদী উন্নতির কথা মাথায় রেখেই ওই মন্তব্য করেন রেলমন্ত্রী। |