|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
বেপরোয়া বেডরুমে... |
ঠুনকো সম্পর্কের মুখোমুখি। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
কখনও কখনও একটা সিনেমার বাস্তবতা যাকে পর্দার বাস্তবতা বলা হয়-জীবনের বাস্তবতা থেকে আমাদের সরিয়ে নিয়ে যায় অনেক দূরে। তখন হলের মায়াবী আলো অন্ধকার থেকে বেরিয়ে যেই রাস্তা পার হতে চাই আমরা, অমনি বাসের হর্নের শব্দে চমকে উঠি, অমনি ফুটপাথে তেড়েফুড়ে থাকা পাথর, লরি, মাতাল, কুকুর....এসব কিছুর সঙ্গে আগের মুহূর্তের ছেড়ে আসা পর্দার বাস্তবতার একটা সংঘাত তৈরি হয়। যে ছবি যত প্রখর, তার পর্দার বাস্তবতার সঙ্গে জীবনের বাস্তবতার ধাক্কাধাক্কিটাও ততোধিক জোরালো। মৈনাক ভৌমিক যে একটা সাহসী ছবি তৈরি করে ফেলেছেন তার প্রমাণ মৈনাকের ছবি ‘বেডরুম’ চট করে আমাদের পিছু ছাড়ে না। ছবির ঘোর থেকে বেরিয়ে জীবনের বাস্তবতায় পৌঁছতেও একটু সময় লাগে।
অনেক সময় ভাল একটা গল্প বা উপন্যাস পড়ে মনে হয় এ থেকে একটা ভাল ছবি হতে পারে। মৈনাকের ‘বেডরুম’ দেখতে দেখতে মনে হল আরে এই সিনেমাটা থেকে একটা সমকালীন উপন্যাস তৈরি হত। |
|
বেডরুম
রাহুল, পার্নো, তনুশ্রী, পাওলি, আবির, রুদ্রনীল, ঊষসী |
তার কারণ হতে পারে এই যে ‘বেডরুম’ ঘটনার বাহুল্যবর্জিত কথোপকথনের ছবি। লম্বা শট, দু’জন কি তিনজন কথা বলে যাচ্ছে---গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যালাপ, পরিবর্তন-সাপেক্ষ যুগের সিনেমার ভাষায় এত লম্বা সংলাপ থাকতে পারে কি পারে না সেটা কোনও ইস্যু হয়ে ওঠেনি। বরং বিষয়ের স্বচ্ছতার এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কারণ জীবনেও অনেক সময় আমরা কথার পিঠে বিবর্তনহীন কথা বলে যাই, যাকে অন্তরচেতনার খোয়ারি কাটা বলা যায়।
এমন তিন যুবক এবং চার যুবতীকে ঘিরে ‘বেডরুম’এর গল্প যারা ব্যক্তিগত জীবনে, বিশেষত সম্পর্কজনিত জায়গায় একটুখানি থিতু হওয়ার চেষ্টা করছে। মানুষ যখন সম্পর্কের জায়গাগুলোতে স্থির হতে চায় বস্তুত তখনই সে সাবালক হয়ে ওঠে। এই প্রজন্মকে দেখেছি যত সামান্য চায় তার তুলনায় অপ্রাপ্তির ছটফটানিটা অনেক বেশি তাদের। ‘বেডরুম’এর চরিত্ররা যেন সম্পর্কে স্থির হতে গিয়ে হয়ে পড়ছে পরীক্ষানিরীক্ষার পক্ষপাতী। এ কারণেই ঋতিকা, প্রিয়াঙ্কা, ঈপ্সিতা, জয়, দেব, আনন্দদেরআমাদের খুব চেনা মনে হয়। মনে হয় একটা সান্ধ্য কফি শপে ঢুকে পড়লেই এদের প্রত্যেকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যাওয়া সম্ভব। দু’টো তিনটে ছোটখাটো ত্রুটি রয়েছে ‘বেডরুম’এ। |
|
যেমন এক জন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকরির খোঁজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কিংবা ‘জন অরণ্য’-র কায়দায় বসকে নারী উপহার দিয়ে চাকরি ফিরে পাওয়া, এই ব্যাপারগুলো ঠিক সমান্তরাল ভাবে যায় না চিত্রনাট্যের সঙ্গে। আবার দেবরূপী রুদ্রনীলকে দুর্দান্ত অভিনয় সত্ত্বেও বাংলা সিনেমার হার্ট-থ্রব নায়ক হিসেবে ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু ভাল দিকও আছে। প্রত্যেকটা চরিত্রায়ণ ডিটেলে ভরা। প্রিয়াঙ্কার চরিত্রে পাওলির হাতে নোয়া, মাথায় সিঁদুর আর পরনে কাঁধ খোলা ছোট পোশাক, তার শৌখিন গৃহস্থালি, সেই জীবনটাও যে সত্যি জীবন, বিয়ে ব্যাপারটা কী, এর ধারণা এবং বিশ্বাসটাই তার নেই বলেই কি প্রিয়াঙ্কার চরিত্র সারাক্ষণ দিন প্রতিদিনকে ক্যামেরা বন্দি করে? পার্নোর প্রবল চাপে ভরা জীবন, জয়ের সঙ্গে তার লিভ-ইন সম্পর্ক, সেটাও একটা সংসার, যে সংসারটা তাকেই চালাতে হয় এবং চাইলেই সেই লিভ-ইন সংসারও ভাঙা যায় না। কারণ অনেকগুলো শেকড় গজিয়ে গেছে। ফলে ভাঙার বদলে পার্নো বা রাহুলের জীবনে গোপনে অন্য পুরুষ বা নারী এসে পড়ে। তৃতীয় যুগল সাংবাদিক ঈপ্সিতা (ঊষসী) ও নায়ক দেব যেমন ইচ্ছে জীবন যাপন করার পর যার-তার সঙ্গে শুয়ে পড়ার স্বাধীনতার মধ্যে বেঁচেও ভেতরে ভেতরে প্রেমে পড়তে চায়, বন্ধনে জড়াতে চায়।
‘বেডরুম’এ তানিশার চরিত্রটাকে এমন একটা চরিত্র বলা যায় যার কোনও রেফারেন্স বাংলা ছবির ইতিহাসে সম্ভবত পাওয়া যাবে না। আর এ রকম একটা রেফারেন্সহীন চরিত্রকে জানলার মতো খোলা দুটো চোখ নিয়ে জীবন্ত করার জন্য তনুশ্রীকে কুর্নিশ। তানিশা এক জন কলগার্ল। যে অপেক্ষা করে আছে ঘোড়ায় চড়ে আসা প্রেমিকের জন্য, যে তাকে লাল স্টিলেটো কিনে দেবে। তানিশাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় জয় (রাহুল)। বিয়ের সাজ সাজে তানিশা এবং জুতোর দোকানের সামনে অপেক্ষা করতে থাকে। জয় আসে। দূর থেকে তানিশাকে দেখে ফিরে চলে যায়। গোটা ছবিকে ছাপিয়ে যায় এই চিরন্তন ব্যর্থতার আবেদনে পরিপূর্ণ দৃশ্য। হৃদয়কে যথার্থ আহত করে। এখানে রূপম ইসলামের ‘হু অ্যাম আই’ গানটা দৃশ্যের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। তানিশার এরকম একটা চরিত্র সৃষ্টির জন্য মৈনাককে সাধুবাদ। সাধুবাদ রূপম আর অ্যালেনকেও। তাঁদের সুর ও গান ছাড়া এ ছবির চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। |
|
‘ছত্রাক’-এর সেই ক্লিপ-এর পর এই প্রথম বড় পর্দায় পাওলি। বাঙালির যাবতীয় কৌতূহলে জল ঢেলে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটা চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এক কমিটেড গৃহবধূর চরিত্রে মসৃণ অভিনয় তাঁর। চোখে পড়েছে মধ্যবিত্ত মানসিকতার আনন্দ-র চরিত্রে আবিরের ভীরু অভিনয়ও। ক্যামেরা যে চলছে সেটা বোঝা যায়নি ঊষসী বা রুদ্রনীলের অভিনয় দেখেও।
কিন্তু পার্নোর নিরুত্তাপ অভিনয় এবং তাঁর পাশে রাহুলের অবাধ অভিনয় মোহিত করেছে। স্বগতোক্তির দৃশ্যে আলোর ব্যবহারে মনে হয় রাহুলের চোখ যেন গলে পড়ছে। সুপ্রিয় দত্তর ক্যামেরার কাজে অপ্রত্যাশিত ভাবে শেষ হতে থাকা শটগুলো ছবিটাকে একটা নতুন ভাষা দিয়েছে। আর মৈনাকের লেখা দুর্দান্ত সংলাপ- “আমার থেকে এক্সপেকটশেন? আমি তো সিপিএম,” কিংবা বাংলা সিনেমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ‘মা, মাসি, মানুষ’ এই ছবির সম্পদ। প্রিয়ম দাশগুপ্তর সেটও যথাযথ।
কিছু ছবি সময়কে এক অদ্ভুতভাবে ধারণ করে থাকে। ‘বেডরুম’-কেও সেই রকম ‘সময়ের ছবি’ বলে চিহ্নিত করা যায়। যদিও আপামর বাঙালি দর্শক হয়তো এই ছবির বিষয়ের সঙ্গে একাত্ম না-ও হয়ে উঠতে পারেন। তার কারণ, এই ধরনের বিষয়কে বুঝতে হলে এই ধরণের জীবন যাপন করতে হয়। |
|
|
|
|
|