চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
বর্ণের প্রতিফলন থেকেই আভাসিত সুরেলা পরিমণ্ডল
প্রবীণ শিল্পী শ্যামল সেন দীর্ঘ দিনের চর্চায় জলরং মাধ্যমে নিজস্ব এক প্রকাশভঙ্গি তৈরি করেছেন। তাঁর ছবি সহজ ও সাবলীল। প্রকৃতির সজল এবং স্বাভাবিক আলোকদীপ্ত উপস্থাপনা। গ্যালারি ৭৯তে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল জলরঙে আঁকা একগুচ্ছ নিসর্গের ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনী।
জলরংকে অনেকেই বলে থাকেন বেশ কঠিন মাধ্যম। এই মাধ্যমটি শিল্পীর আত্মপ্রত্যয় ও প্রকরণজ্ঞানের নিশ্চয়তা দাবি করে। এখানে ভুলের কোনও ক্ষমা নেই। ভুল মানে মৃত্যু। তেলরঙে মুছে ফেলে ভুল শোধরানো যায়। জলরঙে তা যায় না। তাই যে শিল্পী যত অভিজ্ঞ, জলরঙে তাঁর দক্ষতা তত পরিশীলিত। কিন্তু দক্ষতাই শেষ কথা নয়। আত্মপ্রত্যয়ের ভিতর দিয়ে পরিস্ফুট হয় শিল্পীর কবিমন। সজলতার জন্যই জলরং সহজে মেলে ধরতে পারে এর ধরনের লিরিসিজম, কাব্যময়তা। জলে দ্রবীভূত করে বর্ণ আরোপের যে প্রকরণ, সেটাই জলরং। প্রবহমানতা বা গড়িয়ে যাওয়া জলের ধর্ম। এই প্রবহমানতার সঙ্গে সঙ্গে চলে অন্তর্মুখী টান। অর্থাৎ কাগজও শুষে নেয় জলে দ্রবীভূত কিছু রং। শুষে নিয়ে আবার প্রতিফলিত করে। এক পর্দার উপর যখন পড়ে আর এক পর্দা রং, তখন নীচের পর্দার বর্ণের প্রতিফলন, উপরের পর্দাকে উদ্ভাসিত করে। স্বচ্ছতার এই বিচিত্র বুনন থেকেই আভাসিত হয় লিরিসিজম বা সুরেলা পরিমণ্ডল। আলোর প্রতিফলন ঘটে এভাবে। এই আলোকসৃষ্টির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে কাগজের শুভ্রতাকে ছেড়ে যাওয়ার ভিতর দিয়ে। অব্যবহৃত এই শুভ্রতা প্রথম পর্যায়ে শূন্যতার দ্যোতক। এই শূন্যতার ভিতর থেকে প্রাণকে বের করে আনা, জলরঙের শিল্পীর কাছে চ্যালেঞ্জ-স্বরূপ। যিনি পারেন, তিনি এটা খুব সহজেই পারেন।
শিল্পী: শ্যামল সেন
এর সমৃদ্ধ দৃষ্টান্ত আমরা বলতে পারি, জলরঙে দক্ষ ছিলেন কোম্পানি স্কুলের শিল্পীরাও। স্বাভাবিকতার দিকে তাঁদের ঝোঁক ছিল বেশি। নিমগ্ন কাব্যময়তার দিকে ততটা নয়। স্বদেশচেতনা বা ঐতিহ্য-অন্বিত আধুনিকতার ধারার প্রথম পথিকৃৎ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। আমাদের আধুনিক চিত্রকলায় জলরঙের প্রথম সার্থক রূপকারও বলা যেতে পারে তাঁকেই। তাঁর ১৯১৯-২০ সালের ‘দার্জিলিং-হিমালয় রেলপথে’র নিসর্গ বা ১৯৩০-এর ‘আরব্য রজনী’ চিত্রমালার জাপানি আঙ্গিক সমন্বিত রূপারোপে জলরঙের নিমগ্ন কবিতাকে উদ্ভাসিত করেছিলেন তিনি। গগনেন্দ্রনাথ হয়ে রবীন্দ্রনাথে পৌঁছে জলরং অন্য এক দিগন্তকে মেলে ধরল। রবীন্দ্রনাথ জলরঙে আনলেন অন্তর্মুখী নিমগ্নতা। অন্তর্লোকের উদ্ভাসন। সেই ধারা প্রবাহিত হয়ে এসেছে চল্লিশ পেরিয়ে ১৯৬০-এর শিল্পীদের হাতে স্বতন্ত্র এক মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। শ্যামল দত্তরায়ের ছবিতে জলরং আর পেলব কাব্যিকতার সীমায় আবদ্ধ রইল না। গাঠনিকতার মধ্য দিয়েই তুলে ধরল সামাজিক সংকটের বিপন্ন রূপ। ভূপেন খক্কর বা অর্পিতা সিংহের ছবিতেও জলরং এই গভীর অন্বেষণের মাধ্যম হয়ে উঠল।
শ্যামল সেন ১৯৬০এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী। এখন সহজ প্রকাশের স্বচ্ছ জলরং নিয়ে নিমগ্ন চর্চা করছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তাঁর নিসর্গের ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য শুভ্রতাকে অবিকৃত রেখে আলোকসৃষ্টির কাব্যময় বৈচিত্রকে মেলে ধরা।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে চিলিকা হ্রদের নিসর্গের একটি ছবির উল্লেখ করা যায় দৃষ্টান্ত হিসেবে। সম্মুখভাগে জলরাশি, তার উপর ভাসমান সারিবদ্ধ নৌকা কালোর প্রত্যয়দীপ্ত ছোপে আঁকা। দূরে জলভূমি পেরিয়ে দিগন্তের বৃক্ষশ্রেণির আভাস অতিক্রম করে সাদা মেঘ ছড়ানো নীল আকাশের বিস্তার। ছবির বিষয় বলতে এটুকুই। এর মধ্যেই কাব্যময়তার প্রকাশ ঘটেছে জলে বা আকাশে শুভ্রতার শূন্যতায় হাল্কা বর্ণের আবেশ এনে যে ভাবে তিনি আলো সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে। এই বৈশিষ্ট্যটিই তাঁর ছবিকে আকর্ষক করে তোলে। শান্তিনিকেতনের নিসর্গগুলিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ছাতিমতলার ছবিটিতে স্বাভাবিকতার ভিতরেই উদ্ভাসিত হয় এক মগ্ন আধ্যাত্মিকতা।
এই সহজের উদ্ভাসনেই তাঁর ছবির মুক্তি এবং সীমাবদ্ধতাও। জীবনের গভীরতর অন্বেষণ থেকে বিরত থেকেছেন তিনি, যা তাঁর প্রজন্মের পূর্বোক্ত শিল্পীদের ছবিতে পাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.