সামান্য বচসা থেকে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া পূর্বস্থলীতে নতুন কিছু নয়। এলাকায় বোমা ও অস্ত্রের এমন রমরমা চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই। গত দেড় বছরে বেশ কিছু অপরাধমূলক ঘটনার প্রেক্ষিতে তদন্তে নেমে পুলিশ এবং সিআইডি উদ্ধার করেছে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র। দফায় দফায় গ্রেফতার করা হয়েছে বেশ কিছু দুষ্কৃতীকে।
পুলিশের দাবি, তাদের জেরা করে জানা গিয়েছে আন্তঃরাজ্য অস্ত্র ব্যবসায়ীরাই আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করে এলাকায়। কয়েক মাস আগেই অস্ত্র কেনার টোপ দিয়ে কালনায় এনে গ্রেফতার করা হয় এমনই এক ব্যবসায়ীকে। তাঁকে জেরা করেও এই অস্ত্র কেনাবেচার ব্যাপারে নানা তথ্য মিলেছে বলে দাবি পুলিশের। পুলিশ জানায়, অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কী ভাবে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, ধৃতদের জেরা করে তা জানা গিয়েছে। ধৃতেরা জানিয়েছে, এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে ওই সব অস্ত্র ব্যবসায়ীর নিজস্ব ‘সোর্স’। স্থানীয় কিছু যুবক এই কাজ করে। তাদের মাধ্যমেই ঠিক হয় দরদাম। চলে কেনাবেচা। বিনিময়ে সোর্স-কে দিতে হয় ‘কমিশন’।
সরকারি পদ্ধতিতে বন্দুক পেতে হলে সময় লাগে প্রচুর। অনেক সময়ে আবেদন করলেও তা মেলে না। কিন্তু এই সব বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সাহায্যে সরকারি ছাপ মারা বন্দুক মেলে সহজেই। সেখানেও মাধ্যম সেই ‘সোর্স’। পুলিশ জানায়, তদন্ত করে জানা গিয়েছে, ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয় এক একটি কাঠের বাঁট লাগানো বন্দুক। তার ট্রিগারের পাশে জ্বলজ্বল করে সরকারি ‘আর্সেনাল নম্বর’। শুধু বন্দুক নয়, সঙ্গে নকল লাইসেন্সও হাতে তুলে দেয় অস্ত্র কারবারিরা। মাস পাঁচেক আগে পূর্বস্থলীর পুলিশ হুগলির বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশ কয়েক জন বেসরকারি সংস্থার কর্মীকে গ্রেফতার করে, যারা গোপনে বন্দুক কিনেছিল। সরকারি ছাপ মারা এই সব বন্দুক কী ভাবে পৌঁছয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে? জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের দাবি, “সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই বেরোয় এ সব বন্দুকগুলি। কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের মাধ্যমে তা পৌঁছে যায় ওই সব ব্যবসায়ীর হাতে। এমনকী চোরাপথে ওই সব বন্দুকে ব্যবহারের গুলিও চলে যাচ্ছে দুষ্কৃতীদের হাতে।”
তবে পুলিশ জানায়, বেসরকারি ভাবে তৈরি কার্বাইন, রিভলভার, পিস্তল মূলত আসে বিহার থেকে। পুলিশের দাবি, এই সমস্ত অস্ত্র পরীক্ষার পরে কিনে নেয় ব্যবসায়ীরা। এ ক্ষেত্রেও মাধ্যম হিসেবে থাকে দালালেরা। ভিন্ রাজ্য থেকে অস্ত্র পাচারের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সড়কপথ ব্যবহার করে না ব্যবসায়ীরা। কারণ, রাস্তায় অনেক সময়ে তল্লাশির ঝুঁকি থাকে। তাই মূলত ট্রেনের মাধ্যমেই পাচার হয় অস্ত্র। কখনও সব্জির ঝুড়িতে, কখনও বা জামাকাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়েও পাচার হয় স্বয়ংক্রিয় পিস্তল, রিভলভার, বন্দুক-সহ নানা অস্ত্র।
পূর্বস্থলীতেই এত অস্ত্র কেনার ধুম কেন? এক দশক আগেও এই এলাকার দুষ্কৃতীদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ ছিল চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ে। এলাকার সমাজবিরোধীরা বর্ধমান ছাড়াও নদিয়া, হুগলি, মুর্শিদাবাদ জেলায় এই সব করে অপরাধ করে বেড়াত। কিন্তু এক সময়ে ওই সব অপরাধে যুক্ত থাকা কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইদানীং ওই সব ‘পেশা’য় ভাটার টান। কারণ, বেশির ভাগ মানুষই এখন বাড়িতে নগদ টাকা বিশেষ রাখেন না। সব গচ্ছিত থাকে ব্যাঙ্কে। নানা অনুষ্ঠানে সোনার গয়না পরার রেওয়াজও মহিলাদের মধ্যে আগের থেকে অনেক কমে গিয়েছে বলে দাবি তাঁদের। এক দুষ্কৃতীর কথায়, “আগে সুনসান রাস্তায় বরযাত্রীর বাসে ডাকাতি করে অনেক গয়না মিলত। এখন সব ইমিটেশন গয়না পরে। বাস আটকে আর বিশেষ লাভ হয় না।”
কিন্তু চুরি-ছিনতাই কমলেও দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্য বেড়েছে অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে। সময়ের সঙ্গে বদলেছে অপরাধের ধরণও। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বেশির ভাগ দুষ্কৃতীই এখন অবৈধ বালি এবং মাটির কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে তোলাবাজি। এই সবের জন্য এলাকা দখল নিয়ে এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর সংঘর্ষ নিত্য ঘটনা। বালি ও মাটির কারবারের রমরমা বজায় রাখতেেই তাই অস্ত্র কিনতে হয়। অবৈধ কারবার থেকেই আসে অস্ত্র কেনার টাকা।
পূর্বস্থলীর বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় স্বীকার করেন, “এলাকায় দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য চলছে বহু বছর ধরে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।” তাঁর দাবি, “অস্ত্র শুধু পুলিশের হাতে থাকা উচিত। তার জন্য যা করা প্রয়োজন তা পুলিশকেই করতে হবে।” বর্ধমানের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “পূর্বস্থলীর দুষ্কৃতীরা তোলাবাজি-সহ নানা দুষ্কর্মের জন্য অস্ত্র কেনে। অস্ত্র সরবরাহের পিছনে রয়েছে একটি আন্তঃরাজ্য চক্র। টানা অভিযান চালিয়ে বহু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।” পুলিশ সুপারের দাবি, টানা তল্লাশির ফলে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এখন সতর্ক হয়েছে। পুলিশের আশ্বাস, আগ্নেয়াস্ত্রের রমরমা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। |