সরকারি হাসপাতালের শিশু বিভাগে রাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক থাকছেন কি না, তা নজরে রাখতে ওয়ার্ডে ওয়েবক্যাম বসানোর সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। প্রথম ধাপে সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিটগুলিতে (এসএনসিইউ) ক্যামেরা বসবে, পরে অন্যান্য হাসপাতালে।
কলকাতার বিসি রায় শিশু হাসপাতাল-সহ রাজ্যের বেশ ক’টি সরকারি হাসপাতালের শিশু বিভাগে রাতে হানা দিয়ে স্বাস্থ্য-কর্তাদের মোটেই সুখকর অভিজ্ঞতা হয়নি। দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ জায়গায় রাত ন’টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত থাকছেন শুধু কয়েক জন জুনিয়র ডাক্তার। বস্তুত সন্ধের পরে সিনিয়র ডাক্তারদের হাসপাতালে না-থাকাটাই ‘রেওয়াজে’ দাঁড়িয়েছে বলে স্বাস্থ্য-কর্তাদের অভিযোগ।
এই অবস্থার অবসানে রাজ্যের সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নির্দেশ জারি করেছেন স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্র। তাতে বলা হয়েছে, ডাক্তারদের ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে হবে দিনে অন্তত তিন বার সকাল দশটা, সন্ধে ছ’টা ও রাত দশটায়। প্রতি বার কোনও না কোনও শিক্ষক-চিকিৎসকের হাজির থাকা বাধ্যতামূলক। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী রাউন্ডের সংখ্যা তিন থেকে বেড়ে চারও হতে পারে বলে স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন। এত দিন কী চলছে? এক মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান বলেন, “অনেকে সকাল দশটা থেকে বেলা তিনটে-সাড়ে তিনটে পর্যন্ত থাকেন। যাঁর অধীনে কাগজে-কলমে বাচ্চা ভর্তি হচ্ছে, বিকেলের দিকে তিনি হয়তো এক বার বুড়ি ছোঁয়া করে চলে যান। পরে হাউসস্টাফ আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিরাই সব সামলান। সন্ধের পরে কার্যত কোনও সিনিয়র ডাক্তারকে পাওয়া যায় না।”
এবং গত ক’মাসে শিশুমৃত্যুর যে সব ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে, তার অধিকাংশই ঘটেছে সন্ধের পরে কিংবা বেশি রাতে। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রমাণ মিলেছে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার সেই সময়ে হাসপাতালে ছিলেন না। তখন থেকে চিকিৎসকদের উপস্থিতির ব্যাপারটায় গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য-কর্তাদের মতে, রাজ্যে শিশু-চিকিৎসায় পরিকাঠামোর অভাব না-থাকলেও সক্রিয়তার অভাব যথেষ্ট। যে কারণে জেলা হাসপাতালে কেনা ওয়ার্মার আলমারিতে তালাবন্দি হয়ে থাকে। ভেন্টিলেটর এলেও বিদ্যুৎ সংযোগ হয় না। ওষুধ ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছায় না। একই ভাবে, খাতায়-কলমে চিকিৎসক থাকলেও সন্ধের পরে অধিকাংশের দেখা মেলে না।
“সুতরাং রাতে কোনও শিশুর অবস্থা আচমকা খারাপ হলে তার বেঁচে থাকা প্রায়শই ভাগ্যের উপর নির্ভর করে।” আক্ষেপ করছেন এক স্বাস্থ্য-কর্তা। তাঁর বক্তব্য, “কোনও বাচ্চা ভর্তি হলে সকালের আগে তাকে ঠিকঠাক পরীক্ষাও করা হয় না। তাই ভর্তির পরই চিকিৎসা শুরু করা বাধ্যতামূলক হচ্ছে। পাশাপাশি নির্দেশ, ভর্তির ছ’ঘন্টার মধ্যে কোনও শিক্ষক-চিকিৎসক এসে শিশুটিকে দেখে যাবেন।”
বিসি রায়ের অধ্যক্ষ মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সন্ধের পরে একটা রাউন্ড চালু হওয়া খুব জরুরি। বহু ক্ষেত্রেই সেটা হয় না। মনে হয়, যাঁর অধীনে শিশু ভর্তি হচ্ছে, তিনি রাত ন’টা পর্যন্ত থেকে আরএমও-কে দায়িত্ব দিয়ে গেলে অনেক ভাল পরিষেবা দিতে পারব।” কিন্তু ঘটনা হল, অধিকাংশ হাসপাতালে আরএমও থাকেন কোয়ার্টার্সে, অথবা ওয়ার্ডের অনেক দূরে ডিউটি রুমে। তাই এখন শিশু ওয়ার্ড লাগোয়া ঘরে আরএমও-দের থাকার ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে। যাতে প্রয়োজনে তিনি তৎক্ষণাৎ শিশুটিকে দেখতে পারেন। তবে সরকারি এই উদ্যোগ ঘিরে চিকিৎসকদের একাংশের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়েছে। অন্য বিভাগেও রাতে সিনিয়র ডাক্তারদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হবে না কেন, অনেকে সে প্রশ্ন তুলেছেন। যার জবাবে স্বাস্থ্য দফতরের বক্তব্য: বর্তমান সরকার শিশুমৃত্যুর হার কমানোয় অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পরে ধাপে ধাপে অন্যান্য বিভাগেও এই ব্যবস্থা চালু হবে। |