স্বামী বিবেকানন্দ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
যে বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধ-শতবর্ষে বৃহস্পতিবার রাজ্যে ছুটি ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কলকাতায় থাকবেন না বলে জন্মদিনের এক দিন আগেই, বুধবার মহাকরণে স্বামীজিকে শ্রদ্ধাও জানিয়ে গিয়েছেন।
বিবেকানন্দ এবং টাটা।
যে বিবেকানন্দ জাহাজে ভাসতে ভাসতে জামশেদজি নওসেরজি টাটাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ভারতবর্ষে উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়ে তোলা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কতটা প্রয়োজন। তার জন্য টাটাকে এগিয়ে আসতে হবে। যে আহ্বানে জামশেদজি টাটা পরবর্তী কালে সাড়া দিয়েছিলেন। বেঙ্গালুরুতে গড়ে উঠেছিল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)। যাকে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তো বটেই, এ দেশেই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ‘প্রথম সফল মডেল’ মনে করে সংশ্লিষ্ট মহল।
টাটা এবং মমতা।
যে জামশেদজি’র বংশধর রতন নভল টাটা তাঁর গাড়ি কারখানা তৈরি করতে না-পারার জন্য মমতাকে দোষারোপ করেই এ রাজ্য ছেড়েছেন। এই সে দিনও বলেছেন, ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ পরিবেশ তৈরি হলে তবেই পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ করবেন।
বিবেকানন্দ, টাটা এবং মমতার এই ‘নাটকীয়’ সমাপতন সামনে চলে আসছে একটি নাটকের সৌজন্যে! ঘটনাচক্রে, যার নাট্যকার আবার ‘মার্ক্সবাদী’ বলে পরিচিত!
যে নাটক দেখাচ্ছে, শুধুই আধ্যাত্মিকতা নয়, বিবেকানন্দের জীবনে অন্য বার্তাও ছিল। দেখাচ্ছে বিবেকানন্দ এবং টাটার আলাপচারিতা। যে নাটকের জেরে ফের প্রশ্ন উঠছে, দেড়শো বছর আগে জন্ম নেওয়া এক বঙ্গসন্তানের জীবন থেকে ঠিক শিক্ষা নিতে পারলে এই পশ্চিমবঙ্গের, এই সমাজের ভবিতব্যে কি এত বিতর্ক থাকত? বিশেষত, যে পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন নিয়েও হানাহানির রাজনীতি।
এই নাটকই ফের সামনে আনছে এ রাজ্যে বহুচর্চিত প্রশ্ন উৎকর্য কেন্দ্র গড়ে তুলতে, উন্নয়নের অনস্বীকার্য প্রয়োজনীয়তাকে মেনে নিতে যাবতীয় সঙ্কীর্ণতা অতিক্রম করা গিয়েছে কি? যে রাজ্যে জামশেদজি’র বংশধরের একটি গাড়ি কারখানা তৈরির প্রয়াস ধুন্ধুমার বাধায়, ‘টাটা’ নামে রয়ে যায় ‘স্পর্শকাতরতা’, সে রাজ্যে এমন নাটক ভিন্ন ‘তাৎপর্য’ পাচ্ছে বৈকি! ঘটনাচক্রে, বিবেকানন্দের জন্মদিনে ট্যাংরায় যখন নাটকটি অভিনীত হচ্ছে, তখন তার থেকে স্বল্প দূরত্বে মিলন মেলা প্রাঙ্গনে চলছে ‘বেঙ্গল লিড্স’ শীর্ষক শিল্প-সম্মেলন। যে সম্মেলনেরও উদ্দেশ্য রাজ্যের উন্নয়ন।
‘ভারতের সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ’-র যবনিকা উঠেছে দু’মাস আগে। প্রথম শো-র সূচনা হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন সারদা মঠের সাধারণ সম্পাদক দিব্যানন্দজি’র উপস্থিতিতে। নাটকের বক্তব্যের মতোই নাট্যকারের পরিচয়ও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। নাট্যজগতে সমীর মজুমদারের পরিচিতি উৎপল দত্তের ‘শিষ্য’ হিসাবে। ‘মার্ক্সবাদী’ চর্চায় অভ্যস্ত প্রবীণ নাট্যকার শেষে বিবেকানন্দে? সমীরবাবু বলছেন, “কে বলল বিবেকানন্দ মানে শুধু ঠাকুর, ঠাকুর! পাশ্চাত্যে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের আমরা আধ্যাত্মিকতার স্বাদ দিতে পারি। তোমরা আমাদের প্রযুক্তি দাও, শিক্ষা দাও। মানুষ, দেশ, সমাজের উন্নয়নের জন্য তাঁর যে প্রয়াস, তা থেকে শিক্ষা নিলে আজ এত বিতর্কের সামনে আমাদের দাঁড়াতেই হত না!” নাট্যকারের আরও সংযোজন, “উৎপলবাবুর কাছে মার্ক্সবাদী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে আমি এটা শিখেছিলাম, যুক্তি ছাড়া কোনও কিছু গ্রহণ করব না। যা করেছি, যুক্তির উপরে দাঁড়িয়েই করেছি।”
আপাতত নাটকটি সম্পর্কে দর্শক-সাড়ায় ‘অভিভূত’ সমীরবাবু। তবে এ কথা মানছেন, “ধূমকেতুর মতো যে জীবন, তাকে একটি নাটকে ধরতে পারা খুবই কষ্টসাধ্য!”
সমীরবাবুর নাম এ রাজ্যের সিপিএম-মহলে পরিচিত। বিবেকানন্দের জীবনের তুলনামূলক কিছু ‘অনালোকিত’ দিক যে স্বল্পচর্চিত, তা মানতেও সিপিএমের আপত্তি নেই। তা হলে এত বছর রাজ্যের শাসক থেকেও বিবেকানন্দ সে ভাবে সিপিএমের রাজনীতিতে ‘আইকন’ হননি কেন? দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীর কথায়, “বিবেকানন্দ পীড়িতদের কথা বলেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে আমরা যা বলি, তার সঙ্গে ওই বক্তব্যের কোনও বিরোধ নেই। যেখানে যেখানে প্রাসঙ্গিক হয়েছে, সেখানে বিবেকানন্দের কথা কিন্তু আমরা বলেছি। কলকাতাতেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মোকাবিলার সময় বিবেকানন্দের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে।” রবীন্দ্রনাথ কখনও সিপিএমের নিজস্ব ঘরানার মনীষী হননি। কিন্তু সিপিএম নেতৃত্বের মতে, ‘প্রাসঙ্গিকতা’ সাপেক্ষে তাঁর কথাও উদ্ধৃত করা হয়েছে।
সদ্যই রবীন্দ্রনাথের সার্ধ-শতবর্ষ উদযাপিত হয়েছে। তারই পিঠোপিঠি বিবেকানন্দ-পার্বণে সমীরবাবুর নাটক প্রশ্ন তুলছে মনীষীরা কি শুধু ছুটি-উদযাপনেই থেকে যাবেন? |