|
|
|
|
মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্য |
রাজভবন আর মহাকরণে যেন দ্বন্দ্বের সুর |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
তাঁর সমালোচকদের ফের এক হাত নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে সমালোচকদের উদ্দেশে তাঁর ‘চ্যালেঞ্জ’ ‘টাচ মি ইফ ইউ ক্যান’!
রাজ্য সরকার প্রতিশ্রুতি মতো কাজ করছে না বলে যে সমালোচনা হচ্ছে, তার কড়া জবাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “সবটাই হয়েছে! যেটা লিখেছ, মিথ্যে কথা। নাকে খত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে! আমার সঙ্গে লড়াই করতে গেলে ডাইরেক্ট ব্যাটিং করতে হবে। আমি লড়াই করি বাঘের বাচ্চার মতো! যেটা পারব না, সেটা বলে দিই। একটা কথা আছে, ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’। আমি বলি, টাচ মি ইফ ইউ ক্যান!”
সমালোচকদের পাল্টা আক্রমণ মুখ্যমন্ত্রী এর আগেও করেছেন। দু’দিন আগেই সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে তাঁর বিরোধী-সহ সমালোচকদের ‘কটাক্ষ’ করেছিলেন। কিন্তু এখন সরকারের সমালোচকদের তালিকায় ঘটনাচক্রে ঢুকে পড়েছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও। যিনি রামপুরহাটের কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনার পর বুধবার প্রশাসনের ‘কড়া ব্যবস্থা’র পক্ষে সওয়াল করেছিলেন এবং বৃহস্পতিবারও সে কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
|
টাচ মি ইফ
ইউ ক্যান
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
(সমালোচকদের উদ্দেশে) |
মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে তা আসেনি, তা নয়। ফলে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা আক্রমণাত্মক মন্তব্যের পরে প্রশাসনিক মহলের একাংশে প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি মুখ্যমন্ত্রী-রাজ্যপাল ‘দ্বন্দ্ব’ শুরুর ইঙ্গিত?
রাজ্যপাল বুধবার বলেছিলেন, তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হলে ‘অন্য ভাবে’ পরিস্থিতি সামলাতেন। যে মন্তব্যে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে বলে প্রশাসনিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা। আর মুখ্যমন্ত্রী এ দিন
বলেছেন, “সমালোচনা করা খুব সহজ!” বস্তুত, গত মঙ্গলবার কলেজের অধ্যক্ষ-নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে রাজ্যপালের কাছে অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ বাম বিধায়করা। তার অব্যবহিত পরেই রাজ্যপালের ওই মন্তব্যে ‘তাৎপর্য’ খুঁজে পাচ্ছে তৃণমূল শিবির।
এ দিনও রাজ্যপাল আবার বুঝিয়েছেন, কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় তিনি ‘বিরক্ত’। স্বামী বিবেকানন্দের ১৫০তম জন্মদিনে ময়দানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল উদ্যানের কাছে তাঁর একটি মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজ্যপাল বলেন, “রাজ্যে অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।” পরপর দু’দিন রাজ্যপালের ওই মন্তব্যে প্রত্যাশিত ভাবেই ‘তাৎপর্য’ দেখতে পাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল। রামপুরহাট কলেজের অধ্যক্ষকে হেনস্থার ঘটনার পর রাজ্যপাল প্রশাসনকে তার ‘দায়িত্ব’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের মতো ‘সম্মাননীয়’ ব্যক্তিদের প্রতি এ ধরনের ঘটনা ‘দুভার্গ্যজনক’ বলে আখ্যা দিয়ে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্ব-সচেতন হওয়ার কথা বলেছিলেন। ময়দানের অনুষ্ঠানে এ দিন তাঁর আগের মন্তব্যের পুনরাবৃত্তির পাশাপাশিই রাজ্যপাল প্রশাসনকে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ‘সক্রিয়’ হওয়ার আর্জি জানিয়েছেন। অধ্যক্ষ-নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি কী মনে করি, তা আগেই বলেছি। কলেজের অধ্যক্ষেরা গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাঁদের উপরে কোনও হামলা হওয়া উচিত নয়। এ ধরনের ঘটনায় অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।” বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপাল প্রথমেই সুশৃঙ্খল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলছাত্রদের দিকে আঙুল
তোলেন। তার পর শুধু বলেন, “ভিতরে ছাত্রদের দেখলেন? শৃঙ্খলা! এই শৃঙ্খলা প্রয়োজন।”
ঘটনাচক্রে, এ দিনই ইস্টবেঙ্গল মাঠে ক্রীড়ামন্ত্রী একাদশ বনাম রামকৃষ্ণ মিশন একাদশের মধ্যে একটি প্রীতি-ফুটবল ম্যাচের উদ্বোধন করেছেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। সচরাচর এই ধরনের অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে দেখা যায় রাজ্যপালকে। এ দিন তা হয়নি। সরকারের একটি সূত্রের বক্তব্য, রাজ্যপাল-রাজ্য সরকার ‘টানাপোড়েনের আবহে’র সূত্রপাত বিধানসভার গত শীতকালীন অধিবেশনে। রাজ্যের প্রস্তাবিত জমি-বিল পেশ করা নিয়ে বিধানসভায় বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের পরে (রাজ্যপালের সই ছাড়াই যে বিল ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল) রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সরকারি সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার যে কিছু ক্ষেত্রে রীতি-নীতি মেনে চলছে না, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ‘অনুযোগ’ করেছিলেন তিনি। শিক্ষায়তনে তাণ্ডবের জেরে রাজ্যপালের ‘প্রতিক্রিয়া’ এবং মুখ্যমন্ত্রীর ‘কটাক্ষ’ ঘটনাপ্রবাহকে কোন দিকে নিয়ে যায়, তা নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।
স্বামীজির জন্মদিনে এ দিন ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে জঙ্গলমহল উৎসবের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “শুধু ভাষণ দিলেই হয় না, কাজ করে প্রমাণ করতে হয়। স্বামীজি বলতেন, গরুরা মিথ্যে কথা বলে না, অনেক সময়ে আমরাই মিথ্যে কথা বলি। আমরা অন্যকে জ্ঞান দিই, পরামর্শ দিই। নিজেরা তা করি না!” মমতার কথায়, “মানুষ তৈরি করা, তাদের চরিত্র গঠন করা আমাদের লক্ষ্য। বন্ধু, সমালোচনা করা খুব সহজ! আমি তো ভগবান নই। আল্লা বা ঈশ্বর নই। সাধারণ একটা মানুষ! আমার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, চেষ্টা করছি। আমার কাছে কেউ ৫ টাকা চাইল। আমি দিতে পারলাম না। তখন সে বলতে শুরু করল, এটা হয়নি, সেটা হয়নি! অপপ্রচার শুরু করল! সব মিথ্যে কথা!”
তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদেরও তীব্র আক্রমণ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “লজ্জা করে না? ৩৫ বছর যাঁরা কাজ করেননি, তাঁরা জবাব চাইতে আসবেন না! জবাব চাইবেন ৩৫ বছর পর। তখন প্রত্যেকটার জবাব দেব!” বিরোধীরা অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবেই সরকারের সমালোচনা অব্যাহত রেখেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিপিএমের হাওড়া জেলা সম্মেলনের সমাবেশে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেমন পাল্টা বলেছেন, “কিছু বলতে গেলেই বলছেন, মাত্র ৭-৮ মাস সরকার এসেছে। ওরা তো ৩৪ বছর ছিল! কিন্তু ৭-৮ মাসের মধ্যেই ভুল করলে, অন্যায় করলে কিছু বলব না?”
কৃষি ও শিল্প দুই ক্ষেত্রেই সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, অভিযোগ করার পাশাপাশিই শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য নিয়েও সরকারের কড়া সমালোচনা করেছেন বুদ্ধবাবু। তিনি বলেন, “শিক্ষায় কী হচ্ছে? এখন কলেজে কলেজে যা হচ্ছে, তা ভাবতে ভয় লাগে! কোথা থেকে তৃণমূলের ছেলেরা এ সব শিখছে? লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই ওরা বলছে, আমরা আসছি। দেখে নেব! আন্দুল কলেজে ছাত্র-হত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন ছাত্র ইউনিয়ন দখল নিয়ে গণ্ডগোল হচ্ছে।” বামফ্রন্টের আমলেও যে ছাত্র ইউনিয়নের দখল নিয়ে গণ্ডগোল হত, তা অবশ্য স্বীকার করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেন, “এখন কলেজের অধ্যক্ষদের মারার ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনার পর মহাকরণ কী প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে? মহাকরণ থেকে যা বলছে, তাতে এরা আরও উৎসাহ পাবে!”
মাজদিয়া কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় এসএফআই অভিযুক্ত। বুদ্ধবাবু অবশ্য বলেন, “আমাদের ছেলেদের বলেছি, একদম ও পথে যাবে না! অধ্যক্ষকে হাত দেখাবে, গালাগাল করবে এ সব হবে না!” রাজ্যের শিক্ষা-ব্যবস্থা চলবে, নাকি কলেজে কলেজে মারামারি হবে, সে প্রশ্ন তুলে বুদ্ধবাবুর মন্তব্য, “কলেজের অধ্যক্ষকে নিরাপত্তা নিতে হচ্ছে। অধ্যক্ষ কলেজে যাচ্ছেন, পিছনে পুলিশ ঘুরছে। এ চলতে পারে না!” ওই সমাবেশেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “মুখে সেলোটেপ দিয়ে বসে থাকা গণতন্ত্রের পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো নয়!”
আজ, শুক্রবারই মুখ্যমন্ত্রীর পূর্ব মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় ফেরার কথা। দেখার, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান তার পর রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের সঙ্গে কথা বলেন কি না। |
|
|
|
|
|