কথা রেখেছেন ‘প্রমাণ’ দিতে বলতে ডাকলেন আমলাদের
জঙ্গলমহলে ‘জবাব’ মুখ্যমন্ত্রীর
তিনি রাজনীতির মানুষ। তাই ‘সত্যি’ কথা না-ও বলতে পারেন। আর তাই রাজ্য ও জেলা প্রশাসন এবং পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তাদের ‘সাক্ষী’ রেখে জঙ্গলমহলে উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার ‘হাল-হকিকত’ জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার, ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামের মঞ্চ থেকে। পাশাপাশি, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, জেলাকে শান্ত রাখার জন্য ‘মা-ভাই-বোনেদের ধন্যবাদ’ দিলেও মাওবাদী প্রসঙ্গ মুখেও আনলেন না মমতা। এমনকী তাঁর সামনে চার মাওবাদী আত্মসমর্পণ করা সত্ত্বেও।
মমতার এ দিনের অনুষ্ঠানের অনেকটাই জুড়ে ছিল ‘সমালোচনার জবাব’। এর আগে দু’দফায় ঝাড়গ্রামে এসে জঙ্গলমহলবাসীকে উন্নয়নের বিবিধ প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ১৫ অক্টোবর ঝাড়গ্রামে এসে তিনি যে সব প্রকল্পের শিলান্যাস ও ঘোষণা করেন, সেগুলোর বিশেষ অগ্রগতি হয়নি বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। সেই ‘সমালোচকদের’ জবাব দিতে এ দিন প্রশাসন ও পুলিশ-কর্তাদের জনতার সামনে দাঁড় করিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং ‘আমদরবারে’ খানিক অপ্রস্তুত কর্তারা বলেছেন, উন্নয়নের কাজ প্রতিশ্রুতিমতোই চলছে।
যেমন, সুবর্ণরেখার উপরে প্রস্তাবিত কেশিয়াড়ি-নয়াগ্রাম সেতু। আনন্দবাজার জানিয়েছিল, সেতুটি নির্মাণের জন্য শুধু মাটি পরীক্ষা চলছে, পাশাপাশি আগে শুরু হওয়া সেচ-বাঁধ-সেতুর বহুমুখী কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজও এখন বন্ধ। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “আমি রাজনীতির লোক, মিথ্যে কথা বলতে পারি। কিন্তু মুখ্যসচিব সরকারি আধিকারিক। উনি সত্যি কথা বলবেন।” এর পরেই মুখ্যসচিবকে ডাক দেন মমতা, “আপনি একটু আসুন প্লিজ। নয়াগ্রামে সেতুর টেন্ডার হয়েছে কি না বলুন।” মুখ্যসচিব সমর ঘোষ ইতস্তত করে আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চের সামনে এগিয়ে আসতেই হাতের কর্ডলেস মাইক্রোফোনটি তাঁর হাতে ধরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সমরবাবু বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে জানাচ্ছি, সেতুর টেন্ডার হয়ে গিয়েছে।”
অতঃপর মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন: “কাগজের অফিসে দু’টো বোতল কিনতে গেলেও টেন্ডার করতে হয়। মালিককে বাদ দিয়ে কর্মীরা টেন্ডার করতে পারেন না। সব কিছুর একটা প্রসেস আছে।”
এর পরে আসে ঝাড়গ্রাম মহকুমা হাসপাতালকে জেলা হাসপাতালে উন্নীতকরণ ও ঝাড়গ্রাম স্বাস্থ্যজেলা গঠনের প্রসঙ্গ। (এর কিছুক্ষণ আগে মঞ্চেই ঝাড়গ্রাম স্বাস্থ্যজেলার ফলক উন্মোচন করেন মুখ্যমন্ত্রী) মুখ্যমন্ত্রী দাঁড় করান রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্রকে, যার পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “উনি দীর্ঘ দিন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কাজ করেছেন।” তার পরেই ছুড়ে দেন প্রশ্ন, “আপনারা নাকি বলছেন, ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ কিছুই হয়নি? সকালে আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়নি। আমি আপনাকে ম্যানিপুলেট করতে বলছি না। কাজ হয়েছে কি হয়নি, পাবলিকের সামনে বলুন।”
সঞ্জয়বাবুর বলেন, “আমরা যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা হয়েছে। আপনি ঝাড়গ্রাম মহকুমা হাসপাতালকে জেলা হাসপাতাল করবেন বলেছিলেন, সেটাও হয়ে গিয়েছে। সরকারি আদেশনামা অনুযায়ী ঝাড়গ্রাম স্বাস্থ্যজেলার দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন এক জন মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিক।” শুনে খুশিমুখে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি নিজেও জানতাম না, এত সব হয়েছে!” পর মুহূর্তে বিরক্ত গলায় তাঁর নির্দেশ, “কেউ (সংবাদমাধ্যম) ভুল তথ্য প্রকাশ করলে এখন থেকে গভর্নমেন্ট রিজয়েন্ডার দেবে। সেন্ড দ্য রিজয়েন্ডার অলসো।”
মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে কাজের হিসেব দিচ্ছেন আমলারা। বাঁ দিক থেকে মুখ্যসচিব সমর ঘোষ, স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র,
ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্ত। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
পুলিশে প্রতিশ্রুত ‘দশ হাজার’ চাকরি সম্পর্কে রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কী ব্যাপার, দশ হাজার নিয়োগ হওয়ার কথা। বলা হচ্ছে, মাত্র হাজার খানেক নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়েছে! ডিজিসাহেব, প্রকৃত বিষয়টা বলে দিন তো! আমি এটা ঠিক জানি না।”
উঠে দাঁড়িয়ে ডিজি বলেন, “প্রচুর আবেদনপত্র জমা পড়েছে। অলরেডি নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এক হাজার হোমগার্ডের নিয়োগ হয়ে গিয়েছে, তাদের ট্রেনিং চলছে। আরও সাতশো হোমগার্ড নেওয়া হবে।” যা শুনে মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, “তার মানে পুলিশে দশ হাজার (এক হাজার নয়) সাতশো জনকে নিয়োগ করা হবে।” মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাসও দেন, “যাঁরা পুলিশের চাকরি পেলেন না, তাঁরা ভুল বুঝবেন না। দশ হাজার পদে দশ লক্ষ যুবক-যুবতীর আবেদন করার অধিকার আছে। এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক তৈরি করে সরকারের বিভিন্ন দফতরে ধীরে ধীরে লোক নেওয়া হবে। এটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস।”
এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর সভার মাঠ ভরাতে তিন জেলার জঙ্গলমহলের ৭১০টি ফুটবল-ক্লাবের (যারা বর্ষব্যাপী পুলিশের উদ্যোগে জঙ্গলমহল কাপে সামিল হয়েছিল) হাজার দশেক খেলোয়াড়কে আনা হয়েছিল। তাঁদের দিয়েই কর্মসংস্থান ব্যাঙ্ক চালু হবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “ডিএম-এসপি’দের বলব, ৭১০টি ক্লাবের যে দশ-বারো হাজার ভাইবোন জঙ্গলমহল কাপে ছিল, তাদের প্রত্যেকের নাম, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা সংগ্রহ করে রাখুন। এদের দিয়েই এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক তৈরি হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন দাবি করেন, “জঙ্গলমহলের মাটিতে দাঁড়িয়ে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তার বেশির ভাগই হয়েছে। এবং রূপায়ণের কাজ চলছে।” আধিকারিকদের তিনি প্রশ্ন করেন, “ছাত্রীদের কত সাইকেল দেব বলেছিলাম?” তথ্য জেনে নিজেই জানান, “১৯ হাজার সামথিং। ন’হাজারের বেশি দেওয়া হয়ে গিয়েছে। বাদবাকি মার্চের মধ্যে হয়ে যাবে।” বার্ধক্যভাতা প্রসঙ্গে ‘সমালোচক’দের উদ্দেশ করে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “বলছে, বার্ধক্যভাতার কাজ নাকি কিছু হয়নি! তিন-চার মাসের মধ্যে ৩১ হাজারেরও বেশি জনের লিস্ট তৈরি করে দেওয়াটা নট এ ম্যাটার অফ জোক, বন্ধু!” এর পরে জনতার উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, “স্বীকার করছেন তো তা হলে?”

মুখ্যমন্ত্রী
মুখ্যসচিবকে দিয়ে বলালেন, টেন্ডার হয়েছে।

স্বাস্থ্যসচিবকে দিয়ে ঘোষণা করালেন,
ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে।

ডিজি-কে দিয়ে বলালেন, হাজার হোমগার্ড
নিয়োগ হয়েছে, আরও সাতশো নেওয়া হবে।

“এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক তৈরি করে
ধীরে ধীরে লোক নেওয়া হবে।”

“ন’হাজারের বেশি ছাত্রীকে দেওয়া হয়েছে।”

“৩১ হাজারের বেশি জনের লিস্ট তৈরি
হওয়াটা নট এ ম্যাটার অফ জোক!”

“২ লক্ষের বেশি কার্ড বিলি হয়েছে।”

“গীতাঞ্জলি প্রকল্প পরিকল্পনায় রয়েছে।”

এ বার রেশনকার্ড। মমতার বক্তব্য, “ছ’লক্ষের বেশি কার্ড দেব বলেছিলাম। দু’লক্ষের বেশি বিলি হয়ে গিয়েছে। বাকিটা মার্চের মধ্যে হয়ে যাবে।” তথ্যের সমর্থন পেতে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্তকে দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ডিএমকে ডাকব। এটা কি ঠিক? ইয়েস অর নো।” জেলাশাসক বলেন, “আমরা ৬ লক্ষ ১৫ হাজার কার্ড তৈরি করেছি। ২ লক্ষের বেশি বিলি হয়ে গিয়েছে। মার্চের মধ্যে বাকিটা হয়ে যাবে।” মাধ্যমিক স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীতকরণ প্রসঙ্গে মমতার দাবি, “১২৪টা স্কুলের মধ্যে পঞ্চাশটা স্কুলে শুরু হয়ে গেছে।” মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে জেলাশাসক ফের উঠে জানিয়ে দেন, “৩১ মার্চের মধ্যে বাকি স্কুলগুলোও উন্নীত হয়ে যাবে।” মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “সমালোচনাকে আমি ওয়েলকাম করি। কিন্তু মিথ্যে অপপ্রচার করা পছন্দ করি না।”
তবে যে প্রকল্পে একটা বাড়িও হয়নি বলে আনন্দবাজার তথ্য দিয়েছিল, গরিবদের জন্য সেই গীতাঞ্জলি আবাস প্রকল্প ‘পরিকল্পনার মধ্যে’ রয়েছে বলে এ দিন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। লালগড়ের আমকলায় কংসাবতীর উপরে সেতু তৈরির জন্য মাটি পরীক্ষা হচ্ছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পে সেতু নির্মাণে কেন্দ্র ৫০ কোটি টাকা দিচ্ছে। পাশ থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিশির অধিকারী প্রকল্পের কাগজ এগিয়ে দেন মমতার হাতে। কাগজ দেখিয়ে মমতা জানান, “প্রজেক্ট ক্লিয়ার হয়ে গেছে। সেতুর প্রসেস চলছে। হুটহাট করে টেন্ডার করা যায় না। সব কিছুই পদ্ধতি মেনে করতে হয়।”
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন এ-ও জানান, রাজ্যে ফি বছর ৩০-৩৫ হাজার সরকারি কর্মী অবসর নেন। গত ক’বছর কোনও নিয়োগ হয়নি। পুলিশ ও শিক্ষক পদে নিয়োগ করতে হবে। তাঁর কথায়, “রাজ্যে নতুন সরকার আসার পরে গত সাত মাসে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার সরকারি কর্মী নিয়োগের জন্য বিভিন্ন দফতর বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে ৫৬ হাজার স্কুলশিক্ষক, ১৮০০ অলচিকি-শিক্ষক। এ সব প্রসেসে আছে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোয় আরও আড়াই লক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলে পার্থদা (শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়) আমাকে বলেছেন।”
গত তিরিশ বছর কোনও মুখ্যমন্ত্রী ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস করেননি এই দাবি করে (যা শুনে মঞ্চে উপবিষ্ট পুলিশ-প্রশাসন কর্তাদের কেউ কেউ মুখ টিপে মুচকি হাসেন। তথ্যও বলছে, ২০০১-এ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঝাড়গ্রামে কৃষি-সেচ বাংলোয় এক রাত ছিলেন।) মমতা বলেন, “ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে ঝাড়গ্রামে পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা হবে। পর্যটন দফতর ও রাজপরিবারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রাজবাড়িতে থাকার ঘর বাড়ানো হবে। আগামী দিনে জঙ্গলমহলে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রকে বলব।” মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “আদিবাসী ভাইবোনেরা ভাল তির-ধনুক চালাতে পারে।” তাই তাঁদের তিরন্দাজির প্রশিক্ষণের ব্যাপারটাও তাঁর ভাবনা-চিন্তায় রয়েছে।
আর জঙ্গলমহলে শিল্পায়ন?
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, “শালবনিতে ওঁরা (জিন্দলরা) কারখানা তাড়াতাড়ি শুরু করে দেবেন বলে আমাকে কথা দিয়েছেন।” গোয়ালতোড়ে হাজার একর জমিতে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে তোলা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.