নিন্দা করল না শাসক দল, উল্টে অব্যাহত দায় চাপানোর অভ্যাসই
মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “ছোট ছেলেদের ছোট্ট ভুল!”
রাজ্য মন্ত্রিসভায় তাঁর ‘আস্থাভাজন’ মন্ত্রী বলে চলেছেন, ‘‘ছোট্ট ঘটনা!’’
সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে ‘দায়’ চাপিয়ে নাটক-সিনেমা-সিরিয়ালের ‘পরিচিত মুখ’ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, “টিভি চ্যানেলে এমন ভাবে দেখানো হচ্ছে, যেন আক্রমণকারী ও আক্রান্তেরা টিভি-সিরিয়ালের তারকা!”
রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে একের পর এক অধ্যক্ষ-নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তা কঠোর ভাবে ‘নিয়ন্ত্রণে’র কোনও প্রয়াস রাজ্য প্রশাসনের তরফে এখনও পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। বরং আক্রান্ত অধ্যক্ষদের ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ অথবা ‘দুর্নীতি’-র কথা বলে দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের ঘাড়েই। যে-পরিস্থিতি দেখে উদ্বিগ্ন রাজ্যপাল, বিশিষ্টজনেরা (যাঁদের একাংশ আবার ‘পরিবর্তনপন্থী’ বলে পরিচিত) এবং অবশ্যই বিরোধী শিবির। ১০ ডিসেম্বর ২০১১ থেকে ১১ জানুয়ারি ২০১২ এক মাসে রাজ্যে মোট সাতটি অধ্যক্ষ-নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে একটি ছাড়া সব ক’টিতেই অভিযুক্ত শাসকদল তৃণমূলের ছাত্র-সংগঠন। একটিতে অভিযুক্ত বিরোধী এসএফআই। একটিতে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনও কাঠগড়ায়। সম্ভবত সেই কারণেই খোদ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন বুধবার রাজ্য সরকারকে তাদের ‘দায়িত্ব’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “শিক্ষক ও অধ্যক্ষেরা অত্যন্ত সম্মাননীয় ব্যক্তি। তাঁরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁদের প্রতি যা ঘটছে, তা দুভার্গ্যজনক। প্রশাসনকে আইনত যা ব্যবস্থা নেওয়ার, তা নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্ব-সচেতন হতে হবে।”ঘটনাচক্রে মঙ্গলবারই বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে বামফ্রন্টের একটি প্রতিনিধিদল রায়গঞ্জ ও মাজদিয়ার কলেজে অধ্যক্ষ-নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলেন। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজ্যপালের এই বিবৃতি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু
রায়গঞ্জের ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ঘটনাকে একাধিক বার ‘ছোট্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। সরকারের হয়ে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল অধুনা মমতার ‘আস্থাভাজন’ পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে। রায়গঞ্জ-কাণ্ডের পর ফিরহাদও ঘটনাটিকে যথেষ্ট ‘লঘু’ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। এ দিন রামপুরহাটের ঘটনার পরেও অভিযুক্ত ছাত্রদের নিন্দা না-করে পুরমন্ত্রী কার্যত অধ্যক্ষকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কথায়, “রামপুরহাট কলেজের ওই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে তদন্ত হবে। তার আগে সহানুভূতি আদায়ের জন্য এ সব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কি না, তা-ও দেখতে হবে।” সেই সঙ্গে অধ্যক্ষের উদ্দেশে তাঁর ‘পরামর্শ’, “নিরপেক্ষ আচরণের মধ্যে দিয়ে অধ্যক্ষদের সম্মানটা অর্জন করতে হয়। সম্মান তো কেউ এমনি এমনি করে না। আর ২১-২২ বছরের বাচ্চা ছেলেরা একটু অধৈর্য হতেই পারে। কিন্তু বড়দের (অধ্যক্ষকে) অনেক বেশি সহনশীল হতে হয়।”শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু আবার এ দিনের গণ্ডগোলের বিষয়টির ‘দায়িত্ব’ খোদ মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ স্বরাষ্ট্র দফতরের উপরই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রথমে তিনি ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে না-চাইলেও প্রশ্নের জবাবে তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “এটা স্বরাষ্ট্র দফতরের দেখার বিষয়।” পাশাপাশিই অবশ্য তিনি জানিয়েছেন, তাঁর যা ‘করণীয়’ তিনি করেছেন আগামী ১৮ জানুয়ারি সব ছাত্র-সংগঠনের বৈঠক ডেকে। কলেজে নির্বাচন নিয়ে নির্বাচনের কমিশনের দ্বারস্থও হয়েছেন।
আপাতত সরকারের দুই জোট শরিকের সম্পর্ক যথেষ্ট তিক্ত। ফলে প্রত্যাশিত ভাবেই কংগ্রেস ওই বিষয়ে সরকার-বিরোধী মন্তব্য করেছে। রাজ্য মন্ত্রিসভার কংগ্রেসি সদস্য মনোজ চক্রবর্তী মহাকরণে বলেছেন, “বাম-জমানায় এসএফআইয়ের দাদাগিরি ছিল। এখনও শাসকদলের সেই প্রবণতাই বহাল। দলমত-নির্বিশেষে প্রশাসনকে এর বিরুদ্ধে কড়া হতে হবে।”
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “রামপুরহাটকে রায়গঞ্জ বানানো হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। সেই কথা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিতও হয়েছিল। তার মানে ধরে নিতে হবে ঘটনা পূর্বঘোষিত। বিধায়কও (স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়) বলছেন, সাজানো ঘটনা। পূর্বঘোষিত ঘটনা হলে তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তো সরকারকে নিতেই হবে। সরকারকে অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে।” প্রসঙ্গত, রায়গঞ্জ ও মাজদিয়ার কলেজে অনেকটা এক ধরনের দু’টি ঘটনা ঘটলেও রায়গঞ্জে অভিযুক্ত তৃণমূল ছাত্র পরিষদ সমর্থকদের প্রতি ‘পক্ষপাতিত্ব’ দেখিয়ে ‘লঘু শাস্তি’ দিয়েই ‘দায়’ সেরেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতাও রায়গঞ্জের ঘটনায় ‘সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ চক্রান্ত’ দেখেছিলেন। যে সূত্রে সূর্যবাবু বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ঘটনাকে প্রশমিত না করে তাতে ইন্ধন দিচ্ছে।”
রাজনীতিতে তৃণমূলের বিরোধীরা যে এমন মন্তব্য করবে, তা প্রত্যাশিত। কিন্তু রাজ্যে ক্ষমতাবদলের আগে ‘পরিবর্তনপন্থী’ বলে পরিচিত বিশিষ্টদের একাংশও এ দিন শিক্ষায়তনে গোলমালের ঘটনায় তৃণমূলকে বিঁধেছেন। প্রবীণ শিক্ষক সুনন্দ সান্যাল যেমন সরাসরিই বলেছেন, “আমাদের ছেলেমেয়েদের গুন্ডা বানানো চলবে না। মুখ্যমন্ত্রী রায়গঞ্জের ঘটনার নিন্দা করলে এমন হত না।” আর প্রবীণ লেখক মহাশ্বেতা দেবীর কথায়, “দিস ইজ নট ডান। ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে সরকার। কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
রায়গঞ্জ কলেজের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ‘ভুক্তভোগী’ দিলীপ দে সরকার বলেছেন, “প্রশাসন কড়া ব্যবস্থা না-নিলে ক্যানসারের মতো এই ব্যাধি চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।” তাঁর সঙ্গে একমত বর্ষীয়ান সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। তাঁর অভিমত, “এমন চলতে থাকলে আর কেউ অধ্যক্ষ হতেই চাইবেন না!” পাশাপাশিই অবশ্য তাঁর ব্যাখ্যা, “ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে বাইরের লোক ঢুকে পড়ছে। ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।” নিন্দা-ধিক্কার জানিয়ে লাভ নেই বলে মনে করছেন, যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক সুকান্ত চৌধুরীও। তাঁর কথায়, “ছাত্র নির্বাচন সম্পর্কে গভীর ভাবে ভাবা দরকার।” ঘটনাচক্রে, যে ভাবনা ভাবতে শুরু করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য।
রাজ্য জুড়ে যখন ঘটনাপ্রবাহে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা, তখনও প্রধান শাসকদল বিষয়টিকে বিরোধীদের ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমালোচনা’ বলে উড়িয়ে দিতেই ব্যস্ত। এখন দেখার, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপালের এ দিনের বিবৃতির পর শাসকদল রাজনীতির খোলস ছেড়ে ‘প্রশাসকের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কি না।

নৈরাজ্যের মাসকাহন



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.