যে দেশের যেমন আচার, সেই দেশের তেমন রাজনীতি। অর্থাৎ যে দেশের যেমন আচার, তেমন রাজনীতিই তাহার প্রাপ্য। সন্দেহ নাই, সেই কারণেই, বাঙালি রাজনীতিকদের আচার-আচরণ, ভাষা-ব্যবহার, ভাবপ্রকাশ যেমন বিস্ময়ে হতবাক করিয়া দেয়, ঘৃণায় স্তব্ধ করিয়া ফেলে, তেমনই স্মরণ করাইয়া দেয় সেই অতুলসম্ভব বাঙালি সমাজের কথা, যেখানে উপরিতলের হালকা সংস্কৃতি-পরায়ণতার ক্ষীণ ভঙ্গুর স্তরটির নীচেই সর্বসময়ে বিরাজমান আক্রমণপরায়ণ, অপমানসর্বস্ব অপসংস্কৃতির সুগভীর সুবিস্তৃত চোরাবালি। তাই পশ্চিমবঙ্গে কোনও সঙ্ঘবদ্ধ রাজনীতি কোনও সঙ্ঘবদ্ধ বিরোধী সমাজের মুখোমুখি হইলেই সৌজন্যের প্রসাধনটি বর্জন করিয়া দাঁতমুখ খিঁচাইয়া উঠিতে হয়, অশোভন ভাষা ও অভদ্রোচিত ভাবের আশ্রয় লইতে হয়, ত্বরিতে সেই তূরীয় তলে চলিয়া যাইতে হয়, যেখানে যুক্তি নাই, তর্ক নাই, আদর্শ নাই, চিন্তা নাই, আছে কেবল ইতরতার লজ্জারহিত প্রকাশ। সম্প্রতিকালে পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যহ এই নির্লজ্জতার সহর্ষ প্রদর্শনী চলিতেছে, কে কাহাকে দেখিবে তাহাই প্রশ্ন। প্রতি দিনই আগের দিন অপেক্ষা মাত্রা আরও এক কাঠি চড়িতেছে। প্রতি দিনই জনসমাজে সে বিষয়ে আলোচনা-গবেষণা চলিতেছে, হা-হুতাশ ঘটিতেছে। তবে সন্দেহ হয়, ইহা নেহাতই লোক-দেখানো। সমাজও আপন পছন্দসই বিনোদনে মজিয়া আছে, রাজ্যের মন্ত্রী সান্ত্রি নেতাদেরও দুই হাতে অপভাষা বিনোদন ছড়াইবার লোভ হু-হু করিয়া বাড়িতেছে।
ইহা নূতন ঘটনা বলা যাইবে না। গত বৎসর নির্বাচনের আগেও প্রাক্তন শাসক দলের নেতাদের মুখে শুনা গিয়াছে কদর্যতম ভাষা, এমনকী কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি-প্রদর্শনও বাদ যায় নাই। ইহাকে এমনকী সাম্প্রতিক ধারাও বলা যাইবে না। বিগত ষাটের দশকের শেষভাগেও রাজনীতির পালাবদল-নাট্যে কুভাষা ও কু-ভাবের ছড়াছড়ি কেহ ভুলে নাই। মাঝের কয়েকটি দশকে যদি আপাত-শোভনতা বজায় থাকিয়া থাকে, তবে সে কৃতিত্ব রাজনীতির নহে, বিরোধী রাজনীতির অভাবই সেই তিক্ততা হ্রাসের কারণ। অর্থাৎ বিরোধী না থাকিলে সমস্যা নাই, কিন্তু কেহ বিরোধিতা করিলেই দুর্বাক্যবাণে তাহাকে শেষ করিয়া ফেলিব: এই হইল মানসিকতা। তাহাতে সুবিধাও আছে। বিরোধীর বক্তব্য বুঝিবার ক্লেশটিও করিতে হয় না। এই আশ্চর্য সংস্কৃতি এক কালে রবীন্দ্রনাথেরও চোখ এড়ায় নাই: “বিষয়টা যত কম বোঝা যায়, ততই হো হো করিয়া চেঁচাইবার সুবিধা হয়।” তবে কিনা, নূতন ঘটনা একেবারে নাই তাহাও বলা যায় না। প্রশাসনের নিম্নতম স্তর হইতে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে এই বহুলপরিমাণ অসংযম ও যথেচ্ছাচার আগে দেখা গিয়াছে কি? একেবারে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকেও নিয়মিত ভিত্তিতে এই ভাবে অপভাষার চর্চা করিতে দেখা গিয়াছে কি? ক্ষমতায় আসিবার কয়েক মাসের মধ্যেই দুর্বৃত্ত-বৃত্তির প্রতি এমন সীমাহীন সহনশীলতার স্পর্ধা আগে দেখা গিয়াছে কি? এই অভূতপূর্ব সার্বিক অসংযম কিন্তু একটি কথা স্পষ্ট করিয়া দেয়। প্রশাসনের নানা দুর্বলতার চিহ্ন দেখা দেওয়ামাত্রই উচ্চ-নীচ-নির্বিশেষে প্রশাসনের প্রতিনিধিরা সংযম হারাইতেছেন, রে-রে এবং হো হো করিয়া উঠিতেছেন। বুঝিতেছেন না যে, ভাষা ও ভাব কিন্তু কেবল অলংকার বা প্রসাধন নহে, সেগুলি আসলে আরও গভীর মানসিকতার প্রতিনিধি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সেই মানসিকতা এই মুহূর্তে রাজ্যব্যাপী মধ্যাহ্ন-সূর্যের মতো জ্বলিতেছে। সেই মানসিকতা লইয়াই বর্তমান শাসক-সমাজ বাকি পথটা হাঁটিবার কথা ভাবিতেছেন কি? যদি তাঁহারা তেমনটাই ভাবেন, তবে বলিতেই হয় সে বড় সুখের সময় হইবে না। |