শিল্পমন্ত্রী বললেন, সরকার কিছুতেই উর্বর জমি শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেবে না।
আর, তার ঘণ্টাখানেক পরে, একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ বললেন, পশ্চিমবঙ্গ কেন, পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া শিল্পের জন্য জমি পাওয়া সম্ভব নয়।
কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে ‘ইকনমিক গ্রোথ ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড প্রায়োরিটিজ’ (পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বিকাশ: চ্যালেঞ্জ ও অগ্রাধিকার) শীর্ষক আলোচনাচক্রে সকালে প্রথম পর্বের বক্তা ছিলেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি রাজ্য সরকারের ঘোষিত অবস্থানেই থাকলেন।
মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, তাঁর সরকার মানবিক, তাই জমি অধিগ্রহণ করবে না। শিল্পমন্ত্রীও কার্যত একই কথা বললেন। আর, দিনের দ্বিতীয় পর্বে জোসেফ স্টিগলিৎজ তুলে আনলেন তাঁর মার্কিন অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, তাঁদের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস পরিবর্ধনের জন্য কিছু জমির প্রয়োজন পড়েছিল। প্রথম লপ্তে খানিকটা জমি কেনা সম্ভবও হল। কিন্তু, তার পরই জমির মালিকরা বেঁকে বসলেন। অসম্ভব দাম হাঁকতে আরম্ভ করলেন। শেষ পর্যন্ত সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হল। |
দেশ আলাদা, ক্ষেত্রও আলাদা কিন্তু পরিস্থিতিটি অভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে এক জন মালিকের কাছে এক লপ্তে বড় জমি পাওয়া কার্যত অসম্ভব। কারণ, এ রাজ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জমি ছোট অংশে বিভক্ত। ফলে, শিল্পপতিদের পক্ষে সরাসরি বাজার থেকে জমি কেনাও দুষ্কর। এত জন মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে জমির দাম স্থির করা অত্যন্ত কঠিন। তার ওপর জমি মাফিয়া, ফাটকাবাজদের হাতে জমি চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়রউইক-এর অর্থনীতির শিক্ষক ভাস্কর দত্ত বললেন, কোনও সরকার যদি সত্যিই ‘মানবিক’ হয়, তা হলে শিল্পের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা তার অবশ্য-কর্তব্য। কারণ, প্রক্রিয়াটি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে ছোট চাষিদের স্বার্থহানির আশঙ্কা প্রবল।
পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সেই সিঙ্গুরের সময় থেকে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন বারবারই বলতেন, এই রাজ্যে জমির মাপ এতই ছোট যে, শিল্পপতিদের পক্ষে সেই জমি বাজার থেকে কিনে শিল্প গড়া সম্ভব নয়। সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কথাটা যে ভুল নয়, সিঙ্গুরই তার প্রমাণ। সেখান ৯৯৭ একর জমিতে মোট মালিকের সংখ্যা বারো হাজারেরও বেশি। কোনও শিল্পগোষ্ঠীর পক্ষেই বারো হাজার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে, প্রত্যেককে রাজি করিয়ে জমি কিনে তাতে শিল্প গঠন করা বোধ হয় সম্ভব নয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই কথা মানতে নারাজ। এই সরকারের মতে, শিল্প গড়তে হলে বাজার থেকেই জমি কিনতে হবে। ক্ষমতায় আসার পর শিল্পপতিদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিল্প চায়। শিল্প তৈরি করতে চাইলে জমি সমস্যা হবে না। তাঁর সরকার জমি ব্যাঙ্ক তৈরি করবে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। শিল্পমহল কিন্তু আশ্বস্ত নয়। সাম্প্রতিক ‘বেঙ্গল লিডস’ বৈঠকেও এই আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে। বেসরকারি শিল্প সংস্থা সরাসরি জমি কিনতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে সরকার কী অবস্থান নেবে, তা স্পষ্ট নয়। জমি ব্যাঙ্কে কোথায় কত জমি রয়েছে, সে জমির চরিত্র কী, কিছুই স্পষ্ট নয়। আরবান ল্যান্ড সিলিং অ্যাক্টও থাকবে, আর সরকার জমি অধিগ্রহণও করবে না দুইয়ে মিলে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে শিল্পমহলের আশঙ্কার কারণ থাকছেই।
শিল্পমহলের এই আশঙ্কা কি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে? আশঙ্কাটি যে উড়িয়ে দেওয়ার নয়, মানছেন জোসেফ স্টিগলিৎজ। তিনি বললেন, শিল্পের জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন জমি। যে রাজ্যে বা দেশে জমি পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা থাকে, সরকারের ভূমিকা সম্বন্ধে সংশয় থাকে, শিল্পপতিরা সেই রাজ্য বা দেশকে এড়িয়ে যেতে চান।
শুধু বেসরকারি বিনিয়োগই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিকাঠামো নির্মাণের কাজও। মানুষের আপত্তি থাকলে সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না, এই নীতির ফাঁসে জড়িয়ে আছে কাটোয়ার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। সেই প্রকল্পের কী হবে, কোনও সদুত্তর নেই। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনের ভাবমূর্তির পক্ষে বার্তাটি বিপজ্জনক।
শিল্পের জমি অধিগ্রহণে সরকারি হস্তক্ষেপ কি শুধু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই প্রয়োজন? মানতে নারাজ জোসেফ স্টিগলিৎজ। বললেন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ার লাভ যাতে গরিব মানুষের কাছে পৌঁছোয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। আর, সরকারই এই স্বার্থরক্ষা করতে পারে। বাজার এই কাজ করে না। বরং, যারা ক্ষমতাবান, তারা বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে, যাতে বাজারের প্রক্রিয়ায় হেরফের করে বেশি সংখ্যক মানুষকে উন্নয়নের লাভ থেকে বঞ্চিত করা যায়।
প্রশ্ন উঠল নতুন জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়েও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির শিক্ষক সঞ্জয় চক্রবর্তী বললেন, নতুন বিলে জমির দাম ও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ মিলে অঙ্কটি এত বেশি হয়ে দাঁড়াবে যে শিল্পের জন্য জমি কেনা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। যে শিল্পের জন্য বেশি জমি প্রয়োজন, তার ক্ষেত্রে যেমন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তেমনই বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। |