বাড়ছে ভর্তুকির বোঝা। কর আদায় বাড়াতে নিয়মিত বৈঠক বসছে। মন্ত্রকে মন্ত্রকে বার্তা পৌঁছেছে, ব্যয়সঙ্কোচ করো। কারণ, আর্থিক ঘাটতিকে লক্ষ্যমাত্রায় বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। আর ঘাটতি বাড়লে বাড়বে মূল্যবৃদ্ধির হারও। দুর্দশা বাড়বে আমজনতার। ফলে আর্থিক সঙ্কট সামাল দিতে ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা, কর আদায় বাড়ানো, পরিকাঠামোয় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো অনেকগুলি দিককে মাথায় রেখে আগামী বাজেট তৈরি করতে চলেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
তবে শেষ পর্যন্ত প্রণববাবু কতটা আর্থিক সংস্কারের পথে হাঁটতে পারবেন, কতটাই বা আর্থিক ঘাটতি কমানোর দিশা দেখাতে পারবেন, তার অনেকটাই নির্ভর করছে উত্তরপ্রদেশ-সহ রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের উপর। ইউপিএ-র জোট সমীকরণ, অর্থাৎ কংগ্রেস কতটা তৃণমূলের উপরে নির্ভরশীল থাকবে, নাকি সমাজবাদী পার্টি নতুন শরিক হবে, তা এই ভোটের ফলেই স্পষ্ট হবে। এ বারের বাজেট কিন্তু তৈরি হয়ে যাবে তার আগেই।
বাজেট সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের মত নেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কাল সন্ধে থেকেই শুরু করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকে এখন একটাই প্রশ্ন, ঘাটতিকে বেঁধে রাখার দাওয়াইটা কী হবে? একশো দিনের কাজের মতো সামাজিক প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো সম্ভব নয়। বরং খাদ্য সুরক্ষা আইন চালু হলে ব্যয়ের বহর আরও বাড়বে। এ দিকে পেট্রো-পণ্য ও সারে ভর্তুকি বাড়ছে লাফিয়ে। তাই ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে আর্থিক ঘাটতির হার বেঁধে রাখতে হলে, আগামী বাজেটে নতুন কোনও বড় ঘোষণা করার সুযোগ বিশেষ নেই বলেই মনে করছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা।
পরের বাজেট হবে ২০১৪-র লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে। আর্থিক সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এ বছরটাকেই কাজে লাগাতে হবে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারকে। যদিও পণ্য পরিষেবা কর ও প্রত্যক্ষ কর বিধি চালু করার মতো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সিদ্ধান্ত এ বছর ১ এপ্রিল থেকে চালু করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই নয়া কর ব্যবস্থার দিকে কিছুটা হলেও এগোতে চাইবে সরকার। সে ক্ষেত্রে আয়করে ছাড়ের ক্ষেত্রে আয়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর মতো স্বস্তি-বার্তা থাকার সম্ভাবনা থাকছে এই বাজেটে।
চলতি অর্থবর্ষে ঘাটতি ৪.৬%-এ বেঁধে রাখার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছিল। তা যে হবে না, নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন প্রণব। তাঁর বক্তব্য, “যা লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, আর্থিক ঘাটতি তার থেকে অনেক বেশি হবে, এটা দুর্ভাগ্যজনক। আর্থিক মন্দা ও ইউরোপের ঋণসঙ্কটের প্রভাব এ দেশেও পড়ছে।” মন্ত্রকের কর্তা তথা বিশেষজ্ঞদের মতে, তা ৬%-এ গিয়েও দাঁড়াতে পারে। বামপন্থীরা চাইছেন, বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার প্রভাব কাটাতে ঘাটতির কথা ভুলে গিয়ে সরকারি ব্যয় বাড়ানো হোক। উল্টো দিকে যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া চাইছেন, ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেট্রো-পণ্যে ভর্তুকি কমাক সরকার। বিনিয়ন্ত্রণ করা হোক ডিজেল-রান্নার গ্যাসের দাম। তাঁর মতে, “কেন্দ্র আর্থিক ঘাটতি নিয়ে চিন্তিত এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ করছে, এই বার্তাটা বাজারে যাওয়া প্রয়োজন।”
কিন্তু বাজারে বার্তা দিতে যাওয়ার আগে আয়-ব্যায়ের হিসেবটাই মিলিয়ে উঠতে পারছে না অর্থ মন্ত্রক। ২০১১-’১২ সালে লক্ষ্যের চেয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কম আয় হওয়ার আশঙ্কা। যোজনা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪.৪১ লক্ষ কোটি টাকা। ব্যয় সঙ্কোচ করে তা ৪.১ লক্ষ কোটিতে নামানো যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু যোজনা-বহির্ভূত খাতে নির্দিষ্ট ৮.১৬ কোটি টাকার অনেক বেশি ব্যয় হতে চলেছে। আগামী বছরের পরিকল্পনায় তাই ১৫%-এর বেশি ব্যয় না বাড়াতে প্রতিটি মন্ত্রকে নির্দেশ পাঠিয়েছে যোজনা কমিশন। প্রণববাবু জোর দিচ্ছেন কর আদায়ে। পরিকাঠামোয় বিদেশি লগ্নি বাড়াতে নিয়ম শিথিল করা, লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর মতো কিছু ঘোষণা আশা করছে সংশ্লিষ্ট মহল। কারণ, ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হলে এ বারই নিতে হবে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। গত লোকসভা ভোটের আগে ৭০ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ মকুবের ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ থাকবে ২০১৩ সালেও। |