প্রথম হুমকিটা ছিল বাবা-মাকে, “যদি কম বয়সে বিয়ে দাও, তা হলে তোমাদের পুলিশে দেব।” পুলিশের নয়, মেয়ের ভয়েই বাবা-মা আর বিয়ের কথা তোলেননি। তবে এতেই থেমে যাননি গাজলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী অঞ্জলি বর্মন। এক, দুই, তিন চার করে সাত-সাতটি নাবালিকার বিয়ে রুখে দিয়েছেন। নাছোড় মেয়ের ‘দস্যিপনা’ দেখে অঞ্জলির মা বলছেন, “মেয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।” চোখ খুলেছে আরও বহু কিশোরীর, যারা আজ অঞ্জলির ডান হাত, বাঁ হাত। গাজলের বিডিও আজমল হোসেন বলেছেন, “অঞ্জলির মতো আর পাঁচটা মেয়ে থাকলে বাল্যবিবাহই এতদিনে উঠে যেত।”
স্কুলে পড়ার সময়েই অঞ্জলি দেখেছেন, গ্রামের মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে হয়, কিছুদিন পরে তারা অন্তঃসত্ত্বা হয়, সন্তান প্রসবের সময় অনেকে মারাও যায়। যদি কেউ বা বাঁচে, তার সন্তান ভোগে অপুষ্টিতে। তাকে তখন বাঁচানোই কঠিন। |
এই পর্যবেক্ষণই অঞ্জলির প্রেরণা। নিজের বিয়েটা নিশ্চিত আটকে অঞ্জলি বছর পাঁচেক ধরে ঘুরছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। স্কুল থেকে স্কুলে। কোথাও নাবালিকার বিয়ের তোড়জোড় শুনলেই অঞ্জলি পৌঁছে যাচ্ছেন তার দরজায়। বাবা-মাকে তিনি বোঝাচ্ছেন, কম বয়সে বিয়ে করলে তার পরিণতি সুখের হয় না। মেয়েকে ‘ঘাড় থেকে নামাতে’ যাঁরা অতিমাত্রায় তৎপর, তাঁরাও স্বীকার করছেন, “অঞ্জলি ঠিকই বলেছে।” গ্রামের দরিদ্র মানুষকে এই ‘ঠিকই বলেছে’ বলানোটা খুব সহজ কথা নয়। কিন্তু অঞ্জলি সেটা করে দেখিয়েছেন। করতে করতেই তিনি সাবালক হয়েছেন। অভিভাবকের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে গত বছর তাঁর বিয়েও হয়েছে। স্বামী বিলাস সর্দার স্ত্রীর কাজে গর্বিত। বাবা গণেশ বর্মন মাস ছয়েক আগে মারা গিয়েছেন। তাঁর মা, ভাই, কাকা-কাকিমা সবাই অঞ্জলির আন্দোলনে সামিল। সোমবার তাঁর এই উদ্যোগের কিঞ্চিৎ স্বীকৃতি পেলেন অঞ্জলি। রাজ্য সমাজ কল্যাণ দফতর থেকে বাল্যবিবাহ রোধে সফল গাজলের দশ কিশোরীকে সংবর্ধনা জানানো হয়। সেখানে পুরস্কৃত করা হয় অঞ্জলিকেও। মালদহ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বলরামপুর গ্রামের বাড়ির দাওয়ায় বসে তাঁর মা জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “আমার মেয়ে কত নাবালিকার উপকার করেছে। আমার বুক ভরে গিয়েছে।”
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে অঞ্জলি প্রচার চালান। গ্রামের হাটে, স্কুলে বাল্যবিবাহ নিয়ে ‘সংকল্প’, ‘ফুলমতি-মিনারা’ ইত্যাদি নাটক অভিনয় করা হয়। বছর খানেক আগে এই নাটকের সূত্র ধরেই অঞ্জলির সঙ্গে পরিচয় হয় মেনকা বাস্কের। সে পারুল গ্রামের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। অঞ্জলি বলেন, “মেয়েটি আমাকে জানায়, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু সে বিয়ে করতে চায় না। পড়াশুনা করতে চায়। পরদিনই মেনকার বাড়িতে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি শুধু মেনকারই নয়, তার নাবালক দাদারও একই দিনে বিয়ে ঠিক হয়েছে। পরিবারের লোকেদের বুঝিয়ে দুই ভাইবোনেরই বিয়ে আটকাতে পেরেছিলাম।”
২০০৬ সালে মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকেই নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে অঞ্জলির প্রচার চলছে। জীবনে প্রথম বাল্যবিবাহ রুখেছিলেন একান্দর গ্রামের সাবিত্রী সরকারের। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন একান্দর গ্রামে। সাবিত্রীর বাবা-মাকে ৩-৪ দিন ধরে বোঝানোর পরে বিয়ে আটকাতে পেরেছিলেন। এর পরে মাঝরা গ্রামের সারদা কর্মকার, দীপিকা মণ্ডল, আলমপুরের দীপালি কর্মকারের বিয়ে বন্ধ হয়েছে। শুধু গ্রামের নাবালিকাদেরই নয়, গাজলের দুর্গাপুর গ্রামে নিজের মাসতুতো বোন বন্দনার বিয়েও আটকেছিলেন অঞ্জলি।
তাঁর কথায়, ‘‘এখনও অনেক কাজ বাকি। থামলে চলবে কেন!” |