পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা নির্বাচনে দলের বিপর্যয়ের জন্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতা’কে দায়ী করল কোচবিহার জেলা সিপিএম। দিনহাটায় অনুষ্ঠিত দলের কোচবিহার জেলা সম্মেলনের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক প্রতিবেদনে ওই অভিযোগ তোলা হয়েছে। প্রতিবেদনের ৪৫-৪৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন’ শীর্ষক আলোচনায় বলা হয়েছে, জেলার ১২৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ফলাফল আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। আসন সংখ্যাও কমেছে। এমন খারাপ ফলাফলের ব্যাপারে দলের জেলা কমিটির সভায় যে ৭টি কারণ উঠে এসেছে, তার মধ্যেই ৫ নম্বরে প্রতিশ্রুতি পালনে বিগত সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর ‘ব্যর্থতা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের উপরে আলোচনার সময়েও প্রতিনিধিরা অনেকেই অভিযোগ করেন, বিদ্যুৎ থেকে শিল্প, বিমান পরিষেবা নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনওটিই পূরণ করা যায়নি। অন্য দিকে, ক্ষমতায় এসেই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কোচবিহারে বিমান পরিষেবা চালু করে দিলেন কোন ‘জাদুমন্ত্রে’? প্রতিবেদনে লেখা অভিযোগ নিয়ে সদ্য নির্বাচিত জেলা সম্পাদক তারিণী রায়ের ব্যাখ্যা, “কেন্দ্রের ব্যর্থতায় সে সময় বিমান চালু হয়নি। আমাদের সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কোচবিহারে বিমান পরিষেবা চালু করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি মুখে বলেছিলেন, কবে ওই পরিষেবা চালুর আশা করছেন। সেটাও সমস্ত পরিকাঠামো তৈরি হয়েছিল বলেই। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তো বোতাম টিপে পরিষেবা চালুর পরেও তা মুখ থুবড়ে পড়েছে!”
তিন দিনের ওই সম্মেলন শেষ হয়েছে সোমবার। প্রতিবেদনে দলের রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও তোপ দাগা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘জনবিচ্ছিন্নতা’র জন্য এ বারের নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে সঠিক পূর্বাভাস দিতে রাজ্য নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছেন। প্রতিবেদনের ৪৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনী প্রচার ছিল অনেকটা ‘আত্মরক্ষামূলক’। ঘন ঘন লোডশেডিং ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিদ্যুৎ দিতে না-পারা, মিড ডে মিল ও বেনফেডের চাল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিরোধীদের প্রচার ‘ক্ষতিকারক’ হয়েছে। ওই আলোচনায় অন্যান্য কারণের মধ্যে নন্দীগ্রামের ঘটনা নিয়ে বিরোধীদের ভিডিও প্রচার এবং ২০০৮-এর ৫ ফেব্রুয়ারির দিনহাটা-কাণ্ড নিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের ভিডিও প্রচার সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘বিরূপ প্রতিক্রিয়া’র সৃষ্টি করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সার্বিক বাম ঐক্য না-হওয়ার প্রভাব, দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের স্বজনপোষণ, দুর্নীতির বিষয়গুলিও তুলে ধরা হয়েছে।
একই ভাবে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জেলার একটিও আসনে সিপিএম প্রার্থীদের জয়ী হতে না-পারার ৭টি কারণ প্রতিবেদনের ৫৩-৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় পর্যালোচনা করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল: সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দিকে প্রায় তিন বছর রাজ্য সরকার একেবারে ‘আমলা-নির্ভর’ হয়ে পড়েছিল বলে মনে হয়েছে। সিঙ্গুরে তৃণমূল-সহ বিরোধীরা একটার পর একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেও সরকার তার মোকাবিলা করতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
দীর্ঘসূত্রিতা, সরকারি ও আধা-সরকারি দফতরগুলিতে দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের হয়রানি বৃদ্ধি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল বলে প্রতিবেদনের বক্তব্য। প্রতিবেদনে লেখা অন্যান্য অভিযোগ প্রসঙ্গেও তারিণীবাবুর বক্তব্য, “বিদ্যুৎও সমস্ত গ্রামে যায়নি কেন্দ্রের ব্যর্থতাতেই। আসলে এ সব নিয়ে বিরোধীদের প্রচারে যে ক্ষতি হয়েছে, প্রতিবেদনে তা-ই বলতে চাওয়া হয়েছে। তবে সরকারের আমলা-নির্ভরতায় বিভিন্ন কাজে দেরি হয়েছে এটা ঠিক। আমলাদের আমরা দায়ী করেছি।” |