গ্রামীণ মানুষের জন্য বছরে একশো দিন কাজ সুনিশ্চিত করতে ঢালাও অর্থ বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। কিন্তু চলতি অর্থবর্ষ ফুরনোর তিন মাস আগে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে গরিবেরা কাজ পেয়েছেন গড়ে সাকুল্যে ১৯ দিন! বাধ্য হয়ে ৩১ মার্চের মধ্যে কাজের দিনসংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে ৫০ দিনের লক্ষ্য ঘোষণা করলেন নতুন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বয়স প্রায় সাড়ে সাত মাস অতিক্রান্ত। এরই মধ্যে ‘কাজে অখুশি হয়ে’ তাঁর সরকারের প্রথম পঞ্চায়েতমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ ও দফতরের সচিব বরুণ রায়কে বদলি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বছরখানেকের মধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে ধরে নিয়ে প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞ সুব্রতবাবুর হাতে তিনি সেই ভার তুলে দিয়েছেন। নতুন পঞ্চায়েতমন্ত্রীও বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন যে, একশো দিনের কাজের মতো জনপ্রিয় প্রকল্পে রাজ্যের হাল অত্যন্ত শোচনীয়।
তাই দায়িত্ব নিয়েই একগুচ্ছ ‘অভিনব’ পরিকল্পনা করেছেন সুব্রতবাবু। পঞ্চায়েতের সামগ্রিক হাল-হকিকৎ বুঝতে মঙ্গলবার যিনি ‘প্রায় নিঃশব্দে’ মহাকরণের রোটান্ডায় ১৮টি জেলার জেলাশাসকদের নিয়ে তিন ঘণ্টা বৈঠক করলেন। এবং জানালেন, “এ রাজ্যে গ্রামোন্নয়নের প্রায় ২৭টি কেন্দ্রীয় প্রকল্প রয়েছে। এর ছ’টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো কী কী?
• মার্চের মধ্যে ৫০ দিন কাজের পরিকল্পনা ঘোষণা করে মন্ত্রী জানিয়েছেন, এখন কাজের শেষে ‘চেক’ পেতে প্রায় চার সপ্তাহ লেগে যায়। এ বার প্রাপক কাজ সেরে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরার আগেই তাঁর হাতে নগদে বা চেকে পারিশ্রমিক তুলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এ জন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলা হবে। তা ছাড়া জেলাশাসকদের বলা হয়েছে একটানা অন্তত ১৫ দিন কাজের ব্যবস্থা করতে।
• গ্রামোন্নয়নে কাজের বিচারে ‘পুরস্কার’ ও ‘তিরস্কার’ চালু হচ্ছে। সুব্রতবাবু বলেন, “পঞ্চায়েত ভাল কাজ করলে যেমন ইনাম পাবে, তেমন খারাপ করলে প্রকল্পের পরের কিস্তির টাকা পাবে না। কারণ, কাজ করতে না-পারাটাও দুর্নীতির মতো অপরাধ।” দফতরের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, ‘কাজ না-করা’ গ্রাম পঞ্চায়েতের তালিকায় প্রাথমিক ভাবে ১৩৫টি নাম এসেছে। এতে সব দলেরই পরিচালিত পঞ্চায়েত রয়েছে। ঠিক হয়েছে, ওই সব এলাকায় বিডিও-ই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজ দেখাশোনা করবেন।
• প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনায় দু’হাজার কোটি টাকা এসে পড়ে রয়েছে দীর্ঘ দিন। ওই টাকায় হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হবে মার্চের মধ্যে।
কোন জেলায় কোন রাস্তা, আগামী দশ দিনের মধ্যে তার তালিকা বানাবেন জেলাশাসকেরা।
• ইন্দিরা আবাস যোজনায় মিউটেশনের সমস্যার কারণে বহু জায়গায় বাড়ি করা যাচ্ছে না। পঞ্চায়েতমন্ত্রী জানান, ভূমি-সচিবের সঙ্গে কথা বলে ঠিক হয়েছে, প্রাপকদের হাতে জমি থাকলে মিউটেশনের ব্যবস্থা হবে। এতে ৮০% ক্ষেত্রে কাজ শেষ করা যাবে বলে সুব্রতবাবুর দাবি।
• কেন্দ্রের হিসেবে এ রাজ্যে বিপিএল-তালিকাভুক্ত পরিবার ২৮.৩%। এর ভিত্তিতেই দিল্লি অর্থসাহায্য দেয়। অথচ রাজ্যের হিসেবে এটা ৪৮%। সুব্রতবাবু জানান, কেন্দ্রীয় হিসেব বহির্ভুত পরিবারগুলোকে টাকার অভাবে ছ’মাস ধরে বার্ধক্যভাতা, বিধবাভাতা দেওয়া যায়নি। এ নিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশের সঙ্গে কথা বলবেন। ২৩ জানুয়ারি রমেশ কলকাতা আসছেন।
• পঞ্চায়েতস্তরে ক’হাজার মামলা জমেছে। উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে অধিকাংশ মামলাতেই দফতর হেরে যাচ্ছে। পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলেন, “মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে নোট পাঠিয়ে একটা স্পেশ্যাল কোর্ট বা ট্রাইবুন্যাল গঠনের আর্জি জানিয়েছি।”
বস্তুত পঞ্চায়েত ভোটের আগে একশো দিনের কাজ, গ্রামীণ সড়ক ও ইন্দিরা আবাস যোজনার মতো প্রকল্প যে তাঁর ‘পাখির চোখ’, এ দিন তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ সুব্রতবাবু। পঞ্চায়েতের কাজে গতি আনতে প্রতিটি জেলায় ‘এরিয়া অফিসার’ পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “জেলার দায়িত্ব থাকবে দুই অফিসারের উপরে। তাঁরা জেলায় গিয়ে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলোর কাজ তদারকি করবেন।” কিন্তু জেলা পরিষদকে এড়িয়ে কি গ্রামোন্নয়নের কাজ সম্ভব? পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলেন, “জেলা পরিষদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন এখনও হয়নি। তা ছাড়া আমাকেও তো জেলা পরিষদগুলোর কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার কথা ভাবতে হবে!” প্রসঙ্গত, রাজ্যের অধিকাংশ জেলা পরিষদ বামেদের দখলে। |