প্রবন্ধ ২...
‘খেঁচড়ি সেন্টার’ নিয়ে আর একটু ভাবুন
শিশু স্বাস্থ্য সুসংহত করার লক্ষ্যে অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারের পরিকল্পনা সেই ১৯৭৫ সাল থেকে। কিন্তু সেই প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত আমরা সুসংহত করে উঠতে পারিনি। অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার ঘিরে নানান সমস্যা। বোদা চাল, খারাপ চাল, খারাপ খাবার এমন অনেক অভিযোগ কর্মীদের বিরুদ্ধে।
কর্মীরাই বা কী করবেন? সরকার টেন্ডার ডেকে কোনও সংস্থাকে সেন্টারগুলিতে খাদ্যশস্য সরবরাহের দায়িত্ব দেয়। মূল সংস্থাটি জেলা বা ব্লক স্তরে বিভিন্ন সংস্থা বা ব্যক্তির মাধ্যমে খাদ্যশস্য সেন্টারগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। রাজ্য স্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন অফিসার বলছিলেন, ‘চালের হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে গুণমানের বদল হয়, আমরা সবাই জানি। কিন্তু সেটা কোথায় কী ভাবে হচ্ছে, স্পষ্ট কোনও ধারণা আমাদের কারওই নেই।’ কর্মীরা প্রায় সকলে জানেন, চালের বস্তার নীচের দিকে খানিক অংশে খারাপ বা ছাতাপড়া চাল থাকার সম্ভাবনার কথা কিন্তু বস্তাবন্দি চালের ওপরের অংশ দেখে কর্মীরা বুঝবেনই বা কেমন করে? আর বাজারে চালের দাম বাড়লে বস্তায় পচা চালের পরিমাণ বাড়ে।
সুপারভাইজাররা তাঁদের দায়িত্বে থাকা সেন্টারগুলির জন্য চাল-ডালের রিকুইজিশান দেন ঠিকই, কিন্তু খাদ্যশস্য সরবরাহের সময় তার পরিমাণের ক্ষেত্রে কোনও সংগতি থাকে না। কখনও কম কখনও বেশি। চালানে যা থাকবে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী তা নিতে বাধ্য হন। এক বার পাওয়ার কত দিন পর চাল-ডাল আসবে তা সুপারভাইজার, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা ব্লক স্তরের কর্মী কেউই প্রায় বুঝতে পারেন না। সরবরাহকারী সংস্থাটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেন্টারগুলিতে চাল পৌঁছাতে না গিয়ে মাঝামাঝি কোনও সেন্টারে বা কর্মীর বাড়িতে চাল-ডাল রেখে চলে যান। সংশ্লিষ্ট কর্মী দিন কয়েক পর সেন্টারে চাল নিয়ে আসেন। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বা কম থাকলেও তাকে নিতে হয়। এই ব্যবস্থায় কুয়াশা, বর্ষার সময় প্রতিবেশী বা কর্মীর বারান্দায় চালের বস্তাতে পোকা ধরবে তাতে আর বিচিত্র কী?
এই পদ্ধতিতে দু’তিন মাস পর পর চাল-ডাল পেলেও ২০১১ সালে বেশ কয়েকটি জেলায় রান্নার তেল পাওয়া গেল মাত্র দু’বার। নুন পেলেন তিন থেকে চার বার। সব্জি জ্বালানি ডিম ইত্যাদির খরচ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী তার ব্যক্তিগত টাকা থেকে খরচ করবেন এবং দু’তিন মাস পর তা ফেরত পাবেন এমনই নিয়ম। গ্রামবাসী কি এই কারণেই জানেন, সরকার থেকে ডিম কেনার টাকা দেয় না?
গত দু’মাস বিভিন্ন কাজে বর্ধমান, পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুর ঘুরতে ঘুরতে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ফেললাম। কেউ কেউ মাসে এক বার অর্ধেক ডিম দিচ্ছেন, কোথাও তাও দেওয়া হচ্ছে না। মনে সন্দেহ, সত্যি সত্যি ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল নাকি? গ্রামবাসীর কথা ভাবুন, মাসের পর মাস এ সব দেখতে দেখতে তাঁরা কী ভাবছেন? ফিরে এসে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি, প্রতি দিন জনপ্রতি অর্ধেক ডিম, অপুষ্টিতে আক্রান্ত মা ও শিশুদের (থার্ড ও ফোর্থ গ্রেড) জন্য প্রতি দিন একটা গোটা ডিমের টাকা এখনও বরাদ্দ করা আছে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও অনেক সুপারভাইজারের অকাট্য যুক্তি, ব্যক্তিগত টাকা খরচ করার পর বিল পড়ে থাকে মাসের পর মাস। কর্মীদের সাম্মানিক ৪৫০০ টাকার একটু কম, এতে সারা মাস চালানো যায় না। প্রকল্পটির এই সব ত্রুটি যদি সত্যি সত্যি সমাধান না করা যায়, তা হলে কয়েক লক্ষ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শিশুর মুখে পরিপূরক খাদ্য তুলে দেওয়া সম্ভব হবে তো?
সমস্যা হল, সব্জি ডিম না-দেওয়া বা বিল আটকে রাখার প্রসঙ্গগুলিতে সুপারভাইজার বা অনেক ক্ষেত্রে সি ডি পি ও-রা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের প্রতি এত বেশি সহানুভূতিশীল যে বৃহত্তর স্বার্থে তৃণমূল স্তরে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করাও কার্যত অসম্ভব। অথচ প্রায় ত্রিশ বছর পর শুরু হওয়া মিড-ডে মিল প্রকল্পটিকে দেখুন, সেখানে আর যা-ই হোক, শিশুর মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া হয় না। আই সি ডি এস প্রকল্পের পুরো ব্যবস্থাটির মধ্যে অদ্ভুত এক অনিয়ম, অবহেলা আর উদাসীনতা। এগুলি কাটিয়ে উঠতে না-পারলে, সরকারি অর্থের সদ্ব্যবহার করার ব্যবস্থা না-করলে শিশু খাদ্য সুনিশ্চিত করা অসম্ভব হবে।
বর্তমানে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হিসাবে কাজ করতে আসছেন বহু শিক্ষিত মহিলা ও ছাত্রী। প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের সমর্থনও রয়েছে কর্মী নিয়োগ ব্যবস্থাটির মধ্যে। সমাজের যে স্তর থেকেই এঁরা আসুন না কেন, কর্ম সংস্কৃতিতে এঁরা এক শ্রেণিভুক্ত। ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখিয়ে, উচ্চ মাধ্যমিক বা স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় নানান অজুহাতে ছুটি। কখনও নিয়ম মেনে, কখনও নিয়ম না-মেনে ছুটি। বহু জায়গাতেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা অনায়াসে অবলীলায় ব্যক্তিগত কাজে দশ পনেরো দিন বা মাঝেমধ্যেই সেন্টার বন্ধ রাখেন। পাহাড়ি অঞ্চলে বা আরও ভিতরের সেন্টারগুলিতে কখনও কখনও ভিন রাজ্য বা দেশে বেশি রোজগারের আশায় মাস তিনেকের পাড়ি। গ্রামবাসী জানেন, দিদিমণি ভুটান গেছেন। সুপারভাইজার জানতে পারেন দেরিতে। কিন্তু জানতে পারলেই বা কী? ছয় মাস সেন্টার বন্ধ রাখলে কর্মী ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কর্মী তার আগেই ফিরে আসেন।
বর্তমানে সেন্টারের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও অনেক জেলায় প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগ হয়নি। কোথাও বা এক জন সুপারভাইজারকে দুটি ব্লকের সেন্টার দেখতে হয়। কারও আবার ৪০-৭০টি সেন্টার। কিন্তু সকলেই তো আর এমনটা নয়। যাঁদের ২০ থেকে ২৫টি সেন্টার, ঠিকমতো নজরদারি করতে তাঁদের সমস্যা কোথায়? অধিকাংশ সুপারভাইজারই কোনও খোঁজ রাখেন না। অনিয়মের কথা উঠলেই সবাই দাবি করেন, ‘আমার সেন্টারগুলিতে এ সব হয় না’! তা হলে যেখানে এ সব হয়, সেগুলো কার সেন্টার?
কর্মক্ষেত্রে অন্যায় বা কাজের প্রতি অবহেলা কেউ টের না-পেলে, নজরদারি না-থাকলে আমাদের অন্যায় করার প্রবণতা বাড়ে বই কমে না। কিন্তু যাঁরা সেন্টার বন্ধ রাখেন বা যাঁরা সেন্টারগুলি যথাযথ ভাবে পরিচালনা করার দিকগুলো দেখেন না, শুধুমাত্র কি তাঁরাই দায়ী? অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কাজগুলি রীতিমত সময়ের দাবি রাখে। কর্মীদের তার এলাকায় ঘুরে ঘুরে এগুলি করতে হয়। এ ছাড়া তাদের উপর বিভিন্ন ধরনের সার্ভের কাজ, জনগণনার কাজ, এমনকী স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন পর্যন্ত। জেলাশাসকের নির্দেশে কর্মীরা গ্রাম ঘুরে ঘুরে সার্ভে করেন। সি ডি পি ও বা সুপারভাইজাররা অনেক সময় তা জানতেও পারেন না। জানতে পারলেও আপত্তিটা করবেনই বা কী ভাবে জেলাশাসকের নির্দেশ বলে কথা!
ব্লক, পঞ্চায়েতের মিটিং থাকে সকাল সাড়ে দশটা বা এগারোটায়। কর্মী মালাদি (যিনি কিছু দিন পঞ্চায়েত ও পুরসভার সেন্টারের কর্মী ছিলেন) বললেন, ‘সেন্টার ছুটি হওয়ার পর সাড়ে দশটায় মিটিঙে যেতে হলে বাড়িতে রান্নাবান্না করব কখন? তাই এ সব ক্ষেত্রে সেন্টারে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। অথচ শ্রমিক শ্রেণির মায়েরা কাজে চলে গেলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সেন্টারগুলিতে বাচ্চাদের কয়েক ঘণ্টা নিরাপদে থাকার জায়গা মেলে। অধিকাংশ বাবাই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চায় না। বাচ্চাগুলোর শেয়াল কুকুরের অবস্থা। একটু খাবার পেলে কী যে খুশি হয়!’ কষ্টে ম্লান হয়ে আসে মালাদির মুখ। মনে হয়, ‘খেঁচড়ি সেন্টারের খেঁচড়ি’ এখনও অনেক শিশুর পরিপূরক খাদ্য নয়, প্রধান খাদ্য। সরকারি নির্দেশে অন্যান্য কাজ ফেলে সেন্টার বন্ধ রাখা, এটার থেকেও কর্মীদের মধ্যে সচেতন বা অবচেতন ভাবে যাই হোক, সামান্য কারণেই সেন্টার বন্ধ রাখার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে না তো?
তার সঙ্গে রয়েছে কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। যারা নিজ নিজ গ্রামের উন্নয়নের ভার তুলে নিতে গিয়ে অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার খোলার সময়ে সেন্টারের ঘাড়ের কাছে নার্সারি বা কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলে বসেন। কর্মীরা গর্বিত আই সি ডি এস সেন্টারের থেকে তাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। এঁরা না-রাখেন বাচ্চার টীকার খবর, না-রাখেন বাচ্চার খাওয়াদাওয়ার খবর। সন্ধে রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া শিশু সকালবেলা ঘুম চোখে বিস্কুট বা মুড়ি মুখে নার্সারি স্কুলে আসে। নার্সারি স্কুলে বৌদ্ধিক ও শারীরিক বিকাশের নামে খালিপেটে বাচ্চারা নাচ, গান, পি টি করে। মায়েরা নিশ্চিন্তে থাকেন, ‘দিদিমণি আজও সেন্টার খুলে নাই’ ভাবতে হয় না। এ ভাবেই অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারের রেজিস্টার খাতায় নিয়মিত অনুপস্থিতকে উপস্থিত দেখিয়ে ও ভুয়ো ছাত্রছাত্রীর নামের তালিকা যেমন করতে থাকে, তেমনই বাড়তে থাকে শিশুর অপুষ্টি আর সরকারি টাকার অপব্যয়।
কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন স্যোশাল সায়েন্সেস-এ সহকারী গবেষক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.