|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
বড় পুঁজি না হয় ‘মন্দ’, কিন্তু সরকার কী করল |
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ এলে নাকি কৃষকের সর্বনাশ হবে। এখন কেমন
আছেন তাঁরা? নেতাদের মুখোমুখি হলে তাঁরা কী জিজ্ঞাসা করতে পারেন?
অমিতাভ গুপ্ত |
এ লড়াই বাঁচার লড়াই। যে ফসল উঠবে, তা বিক্রি হবে তো?
দেশ জুড়ে পর পর এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে যে রাজনৈতিক দলগুলোই তাল সামলাতে পারছে না, সাধারণ মানুষের কথা তো আর বলার মতোই নয়। মুম্বইয়ের অনশন মঞ্চ থেকে অণ্ণা হজারে হাসপাতালে চলে গেলেন, সে খবরে মন দেওয়ার আগেই সংসদে লোকপাল বিল ভেস্তে গেল। সেটা নিয়ে একটু ভাবার আগেই আবার পশ্চিমবঙ্গে খটাখটি লেগে গেল শাসক জোটের মধ্যে। এর মধ্যে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের কথা মনে রাখার ফুরসত কোথায়?
তবে, রাজনীতির মাঠে এই প্রসঙ্গটি দফায় দফায় ফিরতে বাধ্য। কিন্তু, সেখানে যত বারই প্রসঙ্গটা উঠবে, তত বারই আবেগের মারপ্যাঁচে, মেঠো বক্তৃতার দাপটে আসল প্রশ্নগুলো হারিয়ে যাবে, চাপা পড়ে যাবে। কাজেই, রাজনীতিকরা ফের এই প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ার আগে জরুরি প্রশ্নগুলো তুলে রাখা ভাল।
|
চাষির সর্বনাশ হবেই? |
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ এলে কি চাষির সর্বনাশ হবে? যে কোনও ভদ্রগোছের প্রশ্নের মতো এটারও এক কথায় উত্তর হয় না। চাষিরা এখন যে অবস্থায় আছেন, সেটা কি সর্বনাশের তুলনায় উন্নততর? সেটা নির্ভর করছে রাজ্যের ওপর। পঞ্জাব, হরিয়ানার বড় চাষিদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র চাষির তুলনা করলে চলবে না। পঞ্জাবের চাষির অন্য সমস্যা রয়েছে, সবুজ বিপ্লবের বিষ তাঁদের এখনও বহন করে চলতে হচ্ছে সবই ঠিক, কিন্তু শুধুমাত্র বাজারে দর কষাকষির মাপকাঠিতে সে অঞ্চলের বড় চাষিরা পশ্চিমবঙ্গের ছোট জমির চাষিদের তুলনায় অনেকখানি এগিয়ে। দর কষাকষি মূলত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সঙ্গে, চলতি ভাষায় যাঁদের ফড়ে বলে। যে কোনও ব্যবসার মতোই কৃষিতেও এই শ্রেণির ব্যবসার মূলমন্ত্র হল, উৎপাদকের কাছ থেকে যত কম দামে সম্ভব পণ্য কিনে পাইকারি বাজারে যত বেশি দামে সম্ভব সেই পণ্য বিক্রি করা। যেখানে কৃষকের দর কষাকষির ক্ষমতা কম, সেখানে কৃষক কম দাম পাবেন এটাই স্বাভাবিক।
মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির চেহারা কেমন, সেটাও একটা জরুরি বিষয়। মানে, বাজারে প্রচুর ফড়ে রয়েছে, নাকি ফড়ের সংখ্যা খুব কম কৃষকের আর্থিক অবস্থা সেটার ওপরেও নির্ভর করে। ধরা যাক, দুটো রাজ্যের কৃষকদের অবস্থা একেবারে এক রকম তাদের জমির মাপ এক, ফসলও এক। দুটো রাজ্যেই কৃষকের পক্ষে তাদের ফসল সরাসরি বাজারে নিয়ে যাওয়া অলাভজনক, ফলে তাদের ফসল ফড়ের কাছে বেচতেই হবে। রাজ্য দুটোর মধ্যে ফারাক হল, এক রাজ্যে ফড়ের সংখ্যা অনেক, আর অন্য রাজ্যে ফড়ের সংখ্যা হাতে গোনা। শুধুমাত্র এই ফারাকটাই কিন্তু দুই রাজ্যের কৃষকদের অবস্থায় অনেকখানি তফাত করে দিতে পারে।
|
|
যে রাজ্যে বা বাজারে ফড়ের সংখ্যা অনেক, সেখানে তাঁদের মধ্যে ফসল কেনার প্রতিযোগিতা বেশি। তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, অন্য এক জন তাঁর চেয়ে সামান্য একটু বেশি দাম দিতে রাজি হলেই কৃষকরা সেই লোকটির কাছে নিজেদের ফসল বেচবেন। ফলে, প্রত্যেক ফড়েই নিজের লাভ একটু কমিয়ে ফসলের দাম একটু বাড়াতে চান। প্রতিযোগিতার বাজারের যা নিয়ম। তাতে কৃষক ফসলের বেশি দাম পাবেন। অন্য দিকে, যে বাজারে ফড়ের সংখ্যা কম, সেখানে তাঁদের মধ্যে একটা জোট থাকা স্বাভাবিক, এবং সেই জোটে তাঁরা ফসলের ক্রয়মূল্য স্থির করে নিতে পারেন। সেই দাম নিশ্চিত ভাবেই প্রতিযোগিতার বাজারের দামের চেয়ে কম হবে। কোনও ফড়েই তার বেশি দাম দিতে রাজি হবেন না। ফলে, কৃষকের ক্ষতি।
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ এলে এই দুই ধরনের রাজ্যের কৃষকদের অবস্থার হেরফেরও দু’রকমের হবে। যে বাজারে ফড়ের সংখ্যা বেশি, অর্থাৎ প্রতিযোগিতার ফলে কৃষকরা বেশি দাম পান, সে বাজারে ফড়েরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। বিদেশি পুঁজি বাজারে এসে যদি ফসলের দাম বাড়িয়ে দেয়, সেই বর্ধিত দাম দেওয়ার ক্ষমতা এই ফড়েদের থাকবে না, কারণ তাঁদের পক্ষে যতটুকু লাভ না থাকলেই নয়, তাঁরা এত দিন ঠিক ততটুকু লাভ রেখেই ফসলের দাম নির্ধারণ করতেন। সেই বাজার থেকে ফড়ে অদৃশ্য হবেন। যে কৃষকরা এত দিন অপেক্ষাকৃত বেশি দাম পাচ্ছিলেন, তাঁরা আরও একটু বেশি দাম পাবেন। আর, যে বাজারে ফড়ের সংখ্যা কম, এবং ফড়েরা অপেক্ষাকৃত অর্থবান, সেখানেও ফসলের দাম বাড়বে। কিন্তু সেই বাজারের ফড়েরা অত সহজে বাজার ছাড়বেন না। বস্তুত, ফড়েদের সঙ্গে বিদেশি পুঁজির জোটও হতে পারে। ফলে, এই বাজারে চাষিদের লাভ তুলনায় কম হওয়ার সম্ভাবনা।
প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গ কোন ধরনের রাজ্য? এখানে ফড়ের সংখ্যা কম, না বেশি? এই প্রশ্নটির উত্তর জানার কোনও উপায় নেই। কারণ, দেশের কোন রাজ্যের বাজারের চরিত্র কেমন, সে বিষয়ে কোনও বড় মাপের সমীক্ষা কেন্দ্রীয় সরকার কখনও করেনি। তা ছাড়া, একটা রাজ্যের মধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় বাজারের চেহারা চরিত্র বিভিন্ন রকমের হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গেও তা-ই। কাজেই, রাজ্যের কৃষকরা এখন কী অবস্থায় রয়েছেন, আর বিদেশি পুঁজি এলে তাঁদের কী হবে, আপাতত অনুমান ছাড়া সেটা জানার আর কোনও উপায় নেই। তবে, যে কোনও ক্ষেত্রেই, অন্তত স্বল্পমেয়াদে, কৃষকের লাভ। কারণ, এত দিন ফড়েরা যে দামে ফসল কিনতেন, বিদেশি পুঁজি অন্তত প্রথম পর্যায়ে তার চেয়ে বেশি দামেই ফসল কিনবে। দীর্ঘমেয়াদে কী হবে, সেটা অনুমানসাপেক্ষ।
|
দাম বাড়লেই লাভ? |
যারা মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়ে তাঁদের কী হবে? আমরা সচরাচর এই শ্রেণিটিকে কৃষকের শত্রু হিসেবেই দেখি। সেটা অতিসরলীকরণ। এই শ্রেণি না থাকলে যে কৃষকের পক্ষে অনেক সময়ই বাজারে নিজের ফসল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় না, এবং কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ে, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। ভারতের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির কাঠামোয় এই শ্রেণির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যারা ছোট ফড়ে, মানে প্রতিযোগিতার বাজারে করে খেতেন, আর্থিক ভাবে তেমন জোরদার নয়, এমন মানুষদের কী হবে? কারও কাছেই এই প্রশ্নটির কোনও উত্তর নেই। আরও বড় কথা, কারও কাছে প্রশ্নটিই নেই, কারণ রাজনৈতিক ভাষ্যে সচরাচর এই শ্রেণির বিনাশ কামনাই দস্তুর।
পরের প্রশ্ন, বিদেশি পুঁজি ব্যবসা করতে পারে একমাত্র বড় শহরে, যেখানে জনসংখ্যা কমপক্ষে দশ লক্ষ। অর্থাৎ, যদি ওয়ালমার্ট বা কারফুর-এর মতো সংস্থা ভারতে এসে চাষির কাছ থেকে বেশি দামে ফসল কিনে সেটা অপেক্ষাকৃত কম দামেও বাজারে বেচে, তাতে লাভ বড় শহরের বাসিন্দাদের। ক্ষতি গ্রামাঞ্চলের, ছোট শহরের। সেই বাজারে জিনিসের দাম বেড়ে যাবে। ওয়ালমার্ট যখন বড় শহরে বেচার জন্য বেশি দামে ফসল কিনবে, তখন কোনও চাষিই সেই দামের চেয়ে কমে পণ্য বেচতে চাইবেন না। স্বাভাবিক। ফলে, ছোট শহরে, গ্রামের বাজারে যে ফসল আসবে, সেটাও কিনতে হবে বেশি দামে। কিন্তু, সেই বাজারের জন্য তো বিদেশি পুঁজির ঝকঝকে ‘সাপ্লাই চেন’ অর্থাৎ সরবরাহ ব্যবস্থা থাকবে না। সেই বাজারের ফসল চিরাচরিত হাত ঘুরেই আসবে। ফলে, তার দাম এখনকার তুলনায় বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। আর, তাতে কি কৃষকের ক্ষতি নয়? কৃষক শুধু বাজারে ফসল বেচেনই না, বাজার থেকে সব কিছু কেনেনও। অনেক কৃষকই যত পণ্য বেচেন, তার তুলনায় বেশি কেনেন। ফসলের বাড়তি দামে তাঁদের যতটুকু লাভ হবে, বাজারের বেড়ে যাওয়া দরে ক্ষতি তার চেয়ে বেশি হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই রকম কৃষকের অনুপাত কত? জানা নেই। পরিসংখ্যান দুর্লভ। কাজেই, বিদেশি বিনিয়োগ এলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক ভাল থাকবেন না মন্দ, সেই প্রশ্নের উত্তরটি অজানাই থাকছে।
|
কী করে বাঁচবে লোকে? |
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা এখন কেমন আছেন, সেই প্রশ্নটা আরও এক বার করা যাক। ফড়েদের ওপর নির্ভর না করে তাঁদের উপায় নেই, কারণ তাঁরা নিজেদের ফসল বাজারে নিয়ে যেতে পারেন না। বাজারে নিয়ে যাওয়ার পথে দুটো বাধা এক, বেশির ভাগই ক্ষুদ্র চাষি হওয়ার ফলে তাদের উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ বেশ কম, সেটুকু নিয়ে বাজারে যাওয়া পড়তায় পোষায় না; দুই, গ্রাম থেকে পাইকারি বাজারে যাওয়া বহু অর্থ এবং সময়সাপেক্ষ। কারণ, রাস্তা খারাপ, তাতে যথেষ্ট গাড়িঘোড়ার ব্যবস্থা নেই। ফলে, কবে ফড়ের গাড়ি এসে ফসল তুলে নিয়ে যাবে, সেই পথ চেয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। যে দাম পাওয়া যায়, তা মেনে নেওয়াই একমাত্র পথ। অবশ্য, ফসল নষ্ট হয়ে, দেনার দায়ে ডুবে আত্মহত্যা করার একটা রাস্তা আছে বটে। কিন্তু সে কথা থাক। প্রশ্নটা হল, এই রাজ্যের চাষিদের কি এই অবস্থাই হওয়ার ছিল? অন্য কোনও ভবিষ্যৎ কি অপেক্ষা করতে পারত না তাদের জন্য?
অবশ্যই পারত। বিশেষত, যে রাজ্যে সাড়ে তিন দশক ধরে একটা বামপন্থী সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শাসন করেছে, সেই রাজ্যে কৃষকদের এই পরিণতি অক্ষমণীয়। প্রথম কথা, কৃষকদের জন্য সমবায় গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল। পঞ্চায়েত সমিতি স্তর থেকে ব্লক স্তর, মহকুমা স্তরে পাইকারি বাজার গড়ে তোলা উচিত ছিল। কৃষকরা নিজেদের সমবায়ের মাধ্যমে সেই বাজারে ফসল পৌঁছে দিতে পারতেন। অন্তত ব্লক স্তরে ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। গ্রামাঞ্চলে রাস্তার উন্নতি করা উচিত ছিল, যাতে কম সময়ে পণ্য পৌঁছে যেতে পারে বাজারে। যাতে পথেই ফসল পচে নষ্ট না হয়ে যায়। কিছুই হয়নি। কৃষির পরিকাঠামোর কথা উঠলেই মন্ত্রীরা, নেতারা হিমঘরের হিসেব শুনিয়েছেন। শুধু হিমঘর তৈরি হলেই যদি কৃষির পরিকাঠামোর চাহিদা মিটে যেত, তা হলে আর কথা ছিল না। তা হলে অন্তত আলু চাষিদের আত্মহত্যা করতে হত না।
বামফ্রন্ট সরকার এই কাজগুলো করেনি। এই সরকার করবে, তেমন আশা নিতান্তই কম। কেন করেনি, কেন করবে না সেই সমীকরণ গ্রামের বাতাসে ভাসে। এ রাজ্যের ফসলের বাজারে বড় মাপের ব্যবসায়ীদের দাপট প্রবল। চাষির স্বার্থরক্ষা করতে গেলে তাদের স্বার্থহানি হয়। সেটা রাজনৈতিক ভাবে অসম্ভব। যে কোনও সরকারের কাছেই। ফলে, যে বাজারের পরিকাঠামো তৈরি থাকলে বিদেশি পুঁজির সঙ্গে কৃষকরা সরাসরি দর কষাকষি করতে পারত, নেতারা সেই পরিকাঠামো তৈরি করবেন না।
বিদেশি বিনিয়োগ ভাল না খারাপ, সেই প্রশ্নটাই আসলে অনেক দূরের। নেতাদের কাছে আমাদের জানতে চাওয়া উচিত, কবে কৃষকদের ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা হবে? কবে বড় পুঁজির সঙ্গে, বড় মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে কৃষক সমান ভাবে লড়ে যেতে পারবেন?
|
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পাক্ষিক কলাম
‘যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি’ এই সপ্তাহে প্রকাশিত হল না। |
|
|
|
|
|