আগরতলায় আসার ইচ্ছা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাংলাদেশের, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার অবদানকে স্বীকৃতি দিতে একটিবার । কিন্তু ঘাতকের বুলেট সেই ইচ্ছেপূরণ করতে দেয়নি।
পিতার সেই অসমাপ্ত ইচ্ছাকে পূর্ণতা দিতে আর কয়েক ঘণ্টা পরেই নতুন করে সেজে ওঠা আগরতলা বিমানবন্দরের টারম্যাক ছুঁতে চলেছে কন্যা শেখ হাসিনার বিশেষ বিমান। তাতে হাসিনা ছাড়াও থাকবে বাংলাদেশের পাঁচ মন্ত্রী-সহ একটি বড় রাজনৈতিক ও বাণিজ্য প্রতিনিধি দল।
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের তাৎপর্য নিছক একটি ভারতীয় রাজ্যে আসার মধ্যেই সীমিত থাকছে না। বরং, এই সফরকে কেন্দ্র করে তৈরি হতে পারে এক কূটনৈতিক সন্ধিক্ষণ। বিদেশ মন্ত্রকের আশা, গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি না-হওয়ায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে কূটনৈতিক শৈত্য তৈরি হয়েছে, তা অনেকটাই কাটিয়ে দিতে পারবে আগরতলা। পরিণামে উজ্জ্বল হতে পারে তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ। পাশাপাশি হাসিনার আসন্ন সফরে ত্রিপুরা-সহ গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যিক আশা-আকাঙ্ক্ষাও পূর্ণতা পাবে বলেই আশা।
ত্রিপুরার দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে (ট্রানজিট) উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য পরিবহণের বিষয়টি চুড়ান্ত হোক। কিন্তু দিল্লি-ঢাকা আলোচনা তিস্তা (এবং ফেনি) প্রশ্নে ধাক্কা খাওয়ায় খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ত্রিপুরা, মণিপুর, মেঘালয়, অসমের মুখ্যমন্ত্রীকে। তিন দিক বাংলাদেশ দিয়ে ঘেরা ত্রিপুরার দক্ষিণতম বিন্দু থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বন্দর। আগরতলার দীর্ঘ দিনের দাবি, এই বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিক ঢাকা। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। |
ত্রিপুরার এই সরকারি অতিথিশালাতেই থাকার কথা মুজিবকন্যার।
মঙ্গলবার সেখানে টহল নিরাপত্তারক্ষীদের।ছবি: উমাশঙ্কর রায়চৌধুরী |
রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, আগরতলা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেল প্রকল্পের জন্য ২৫০ কোটি টাকা মঞ্জুর করার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনা এবং ত্রিপুরা রাজ্য নেতৃত্বের আসন্ন বৈঠকের একটি ইতিবাচক মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও যে এ ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রয়েছে, তা ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করছেন কেন্দ্রীয়নেতৃত্বও। এটা ঘটনা যে, প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে তিস্তা প্রকল্প আটকে গিয়েছিল মমতারই আপত্তিতে। তারপর বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণি কলকাতায় মমতার সঙ্গে বৈঠক করেন, কিন্তু জট কাটেনি। তবে তিস্তার বিষয়টিকে পৃথক রেখেই মমতা ত্রিপুরা-বাংলাদেশ যোগাযোগের প্রশ্নে সক্রিয়তা দেখিয়েছেন। মমতা রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, হাসিনার ত্রিপুরা সফরের আগেই যাতে আগরতলা-আখাউড়ার রেল যোগাযোগে আর্থিক মঞ্জুরি দেওয়া সম্ভব হয়। মমতার বক্তব্য, “আমি বাংলাদেশকে ভালবাসি। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতিই চাই। কিন্তু তিস্তা চুক্তি নিয়ে রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
ফলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারছেন, আসন্ন ভবিষ্যতে তিস্তার জল গড়াবে না। তাই ত্রিপুরা সফরটি ঘিরে হাসিনার প্রত্যাশা রয়েছে যথেষ্ট। একই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ বাতিল করে তিনি আসছেন আগরতলায়। রাজনৈতিক সূত্রের কথায়, ভারত সম্পর্কে প্রতিটি পদক্ষেপের আগে নিজের দেশের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। কলকাতার ক্ষত যাতে আগরতলা মেরামত করতে পারে তার জন্য হাসিনার আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, বিষয়টি তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সঙ্গেও জড়িত। হাসিনা সরকারের তিন বছর অতিক্রান্ত। বিভিন্ন বিষয়ে প্রবল বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমেছে বিএনপি এবং জামাত জোট। তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি পিছিয়ে যাওয়ায় হাসিনা-বিরোধী প্রচার আরও শানিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। তিস্তার ‘পানি’ স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের একটি বড় আবেগের জায়গা।
ঘরোয়া রাজনীতিতে সেই বিরোধিতা কমাতে আগরতলা-আখাউড়া রেললাইনটি দ্রুত তৈরি হওয়া বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। এটি হয়ে গেলে বাংলাদেশ আগরতলার মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাজার ধরতে সক্ষম হবে। পণ্য রফতানির প্রশ্নে কলকাতার তুলনায় সামগ্রিক ভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চল অনেকটাই বেশি আকর্ষণীয় ঢাকার কাছে। ব্রিটিশ আমলে আখাউড়া ছিল রেলের অন্যতম মুখ্য দফতর। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরায় পণ্য পৌঁছতে ওই লাইন ব্যবহার করা হত। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। তা আবার চালু করার বিষয়টি ঘরোয়া রাজনীতিতে হাসিনাকে বাড়তি সুবিধা দেবে বলেই মনে করছে কূটনৈতিক শিবির। |