নামে কী আসে যায়? নামে কি কিছু আসে যায়? প্রথম প্রশ্নের উত্তর জটিল হইতে পারে, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। হ্যাঁ, বাঙালি হইলে প্রবল রকম আসে যায়। নাম লইয়া বাঙালির মাথা-ঘামাইবার শেষ নাই, নাম বিষয়ে বাঙালির বাদবিতণ্ডার অন্ত নাই। নিন্দুকে বলিতে পারেন, নাম যেহেতু কেবলই বাহ্যিক কিংবা আপতিক, সেই পর্যন্তই বাঙালির দৌড়, তাহার অপেক্ষা গভীরে নামিবার জন্য যে ধীশক্তি কিংবা ধৈর্যশক্তি লাগে, কোনওটাই তাহার ভাণ্ডারে সহজলভ্য নহে। তাই মনীষী পাইলেই ভক্ত বাঙালি তাঁহার নাম ধরিয়া টানাটানি শুরু করে, কিন্তু মনীষার প্রতি মনোযোগী হয় না। তাঁহার কী কাজ, কোথায় সে কাজের গুরুত্ব, এই সব অ-চিত্তাকর্ষক বিষয়ে ভাবনা করিয়া সময় নষ্ট করে না।
এই যেমন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হইতে না হইতে শুরু হইয়া গিয়াছে নামলীলা। পাঠ্যক্রম ঠিক হয় নাই, শিক্ষক নিয়োগ ঠিক হয় নাই, কিন্তু ঠিক হইয়া গিয়াছে বিশেষ নামাঙ্কিত আসনসমূহ। কিছু ক্ষেত্রে আবার নামাঙ্কিত আসন প্রস্তুত থাকিলেও, কোন বিষয়ের জন্য কোথায় তাহাকে ঠাঁই দেওয়া ভদ্রোচিত, সে সিদ্ধান্ত করা যায় নাই। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামে আসনটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের জন্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর না হয় মানববিদ্যা ও সাহিত্যের জন্য, কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের নামে আসনটি? স্থান এখনও অনির্ধারিত। রাস্তাঘাট, রেল-স্টেশন, অধ্যাপক পদ, সর্ব ক্ষেত্রেই অসামান্য উৎসাহ ও উদ্যম লক্ষিত হয় নামকরণের পর্যায়ে। তাহার আগে-পরে, স্বভাবতই, উৎসাহ কিছু অপ্রতুল। বাংলার মেট্রো আর এক অবিস্মরণীয় উদাহরণ। এক-একটি স্টেশন নির্মাণ হওয়া-মাত্র অসীম উদ্দীপনায় উত্তমকুমার হইতে কবি সুকান্ত, সকলেই নাম-মাহাত্ম্যে স্থান করিয়া লইলেন। অথচ মেট্রো রেলের সাংগাঠনিক দুর্বলতাগুলির কিন্তু আজ পর্যন্ত সুরাহা হইল না।
আরও একটি নাম-কুনাট্য চলিতেছে ‘ইন্দিরা-ভবন’ লইয়া। স্বাভাবিক ভাবেই, এই নাম-নাটক আবার আকারে প্রকারে রাজনৈতিক। নামকরণের তালিকায় মাঝেমধ্যেই মনীষীদের খোঁজে হইহই পড়িয়া যায় ঠিকই। তবে তথ্যের খাতিরে বলিতে হইবে যে, ইন্দিরা ভবনের নাম কিন্তু আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রদত্ত হয় নাই। ঘটনাচক্রে লোকমুখে এই নাম অর্জিত হইয়াছিল। তৎকালীন প্রশাসন এই নাম-অর্জনে অযথা উৎকণ্ঠিত হয় নাই, বরং সাবলীল ভাবে মানিয়া লইয়াছিল, তথ্যের খাতিরে ইহাও মনে রাখিতে হইবে। তবে বামফ্রণ্ট যে আপন জমানায় দল-রাজনীতির নিজস্ব নামাবলি তৈরি করিতে উৎসাহী ছিল না, এত বড় কথা বলা যায় না। হাজার হউক, হো চি মিন সরণি-র উদাহরণটি তো রহিয়াছেই। তবে কি না, সেই নামাবলি রাজনীতিতে বেশি দূর তাহারা অবগাহন করে নাই। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইন্দিরা ভবনে থাকিতে কোনও রাজনৈতিক দ্বেষ অনুভব করেন নাই। নিঃসন্দেহে পূর্বতন সরকার যে পথ দেখাইয়া গিয়াছিল, বর্তমান সরকার তাহা বহু দূর আগাইয়া লইয়া গিয়াছে। প্রাক্তন কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীর নামে ভবনটি নামাঙ্কিত হওয়া উচিত হইয়াছিল কি না, ইহা অপেক্ষাও আজ তাই অন্য একটি প্রশ্ন বড় হইয়া উঠে। আজ, অকস্মাৎ, অকারণ, এই নাম পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা-ই বা কী? ইহার অপেক্ষা অধিক অর্থবহ কাজের কি অভাব ঘটিয়াছে? বাম সরকার কলিকাতাকে কলকাতা করিয়াছে বলিয়া বর্তমান সরকারকেও ওয়েস্ট বেঙ্গল নাম বর্জন করিতে ঝাঁপাইতে হইবে? ইন্দিরা ভবনকে নজরুল ভবন করিতে হইবে? আর সব ছাড়িয়া, নজরুলের প্রতিও কি ইহার দ্বারা কোনও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সম্ভব? দল-রাজনীতির চিহ্ন-অঙ্কন ছাড়া এই ‘সংস্কার’-এর আর কোনও উদ্দেশ্য আছে কি? |