রাজ্যে ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ অভ্যর্থনা’ পেলে তবেই তাঁরা আরও বিনিয়োগ করতে আসবেন বলে ফের জানিয়ে দিলেন রতন টাটা। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তাঁদের যে কোনও ‘বিতৃষ্ণা’ নেই, সে কথাও স্পষ্ট করে ফের জানিয়েছেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার। বরং বলেছেন, রাজ্যে বিনিয়োগে তাঁরা আগ্রহীই। কিন্তু সেই বিনিয়োগের প্রায় ‘প্রাক্-শর্ত’ হিসেবেই টাটা উল্লেখ করেছেন ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ পরিবেশের কথা। ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ পরিবেশ বলতে তিনি ঠিক কী বোঝাচ্ছেন, তা খোলসা করেননি টাটা। তাঁর বক্তব্য, এমন কোনও তালিকা (লন্ড্রি লিস্ট) তাঁর কাছে নেই। এবং সেই পরিবেশ বা অভ্যর্থনা কেমন হবে, তা-ও রাজ্যের উপরেই ছেড়েছেন। তবে সংশ্লিষ্ট মহলের ব্যাখ্যা, লগ্নি নিয়ে রাজনীতিই ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ পরিবেশের পরিপন্থী মনে করছেন টাটা।
শিল্প মহলের মতে, কোনও রাজ্যে শিল্পের জন্য ‘বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ’ তৈরির দায়িত্ব মূলত সেখানকার সরকারেরই। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই সৌহার্দ্যের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যৎ লগ্নিতে আগ্রহী হবেন বলে বুঝিয়েছেন টাটা। কিন্তু সিঙ্গুরের জমি কৃষকদের ফেরত দেওয়ার লক্ষ্যে মমতার সরকারের প্রণীত আইন নিয়ে রাজ্য বনাম টাটা মোটর্সের লড়াই এখন আদালতে। এমনকী, সানন্দে টাটার ন্যানো কারখানা দেখার সম্ভাবনা তৈরি হওয়াতেই শিল্পায়ন দেখতে গুজরাত যাওয়ার পরিকল্পনা শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছে বিধানসভার শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। একই সঙ্গে আবার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পরে মমতা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, রাজ্যে বিনিয়োগের জন্য যে কোনও সংস্থাই স্বাগত। পক্ষান্তরে, আমরি-কাণ্ড মোকাবিলায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে দুর্ঘটনাগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ভূমিকার প্রশংসা করে ট্যুইট করেছিলেন টাটাই।
এই ঘটনাপ্রবাহের পরে টাটার এ দিনের বক্তব্যে ইঙ্গিত মিলছে, রাজ্যে বিনিয়োগের প্রশ্নে সিঙ্গুর-উত্তর পর্বে টাটার অবস্থানে কোনও পরিবর্তন হয়নি। বস্তুত, গত ৩০ অগস্ট টাটা টি-র বার্ষিক সাধারণ সভায় টাটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তাঁদের বিনিয়োগ-মানচিত্র থেকে আপাতত ব্রাত্যই থাকবে পশ্চিমবঙ্গ। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের প্রতি যে কারও কোনও বিদ্বেষমূলক মনোভাব নেই, আগে সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। তবেই আর পাঁচটি জায়গার মতো এ রাজ্যেও বিনিয়োগ করব আমরা।” শিল্প মহলের মতে, সেই পুরনো অবস্থানই নতুন মোড়কে পেশ করেছেন তিনি। একই সঙ্গে, সে বারের মতো এ দিনও রাজ্যের প্রতি তাঁদের ‘টান’ বজায় থাকার কথা বলতে গিয়ে রাজারহাটের ক্যানসার হাসপাতালের উদাহরণ টেনেছেন।
অবস্থান পরিবর্তন হয়নি সিপিএমেরও। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল এ দিনই স্পষ্ট ভাবে বলেছে, রাজ্য সরকার ‘নেতিবাচক’ মনোভাব ছেড়ে শিল্পায়নের চেষ্টা করুক। বিরোধী দল হিসাবে তারা সরকারকে ‘ইতিবাচক সমর্থন’ দিতে প্রস্তুত।
টাটার এ দিনের মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও পৌঁছেছে। তবে তিনি এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। টাটার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেননি শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে কলকাতায় পার্থবাবু বলেন, “শোনা কথার উপরে কোনও মন্তব্য করব না।” পক্ষান্তরে, যে বামফ্রন্ট সরকারের জমানায় টাটা গোষ্ঠী সিঙ্গুরে পা রেখেছিল, সেই সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং অধুনা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “আমরা তো বাস মিস করেছিলাম! এই সরকার বাস ধরার চেষ্টাই করছে না!”
দিল্লিতে অটো-এক্সপো শুরুর আগে এ দিন প্রাতরাশের টেবিলে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ফের সিঙ্গুর প্রসঙ্গ তুলে আনেন টাটা। জানান, ন্যানো গাড়ির বর্তমান সমস্যার মূলেও হয়তো কিছুটা সেই সিঙ্গুরই। ঘটনাচক্রে, ২০০৮ সালে দিল্লির এই গাড়ি মেলার মঞ্চে দাঁড়িয়েই সিঙ্গুরে তৈরি ‘আম জনতার গাড়ি’র নাম ‘ন্যানো’ হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন টাটা। চার বছরে অনেক জল গড়ানোর পরে ব্যবসায়িক ভাবে ন্যানো ব্যর্থ কি না, তার উত্তরে এ দিন টাটার পাল্টা বক্তব্য সিঙ্গুরে কারখানার কাজ ৮৫-৯০% এগিয়ে যাওয়ার পরেও তা সানন্দে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল টাটা মোটর্স। তার কিছুটা প্রভাব হয়তো এ ক্ষেত্রে পড়েছে। কিন্তু যে গাড়ি ইতিমধ্যেই দেড় লক্ষ বিক্রি হয়েছে এবং ‘বুকিং’ রয়েছে ৩ লক্ষের, তাকে আদৌ ব্যর্থ বলা যায় কি? সিঙ্গুর আন্দোলনের পিছনে প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার ‘ইন্ধনে’র অভিযোগে অবশ্য এ দিনও অনড় থেকেছেন তিনি।
টাটার মনোভাবের সঙ্গে প্রায় মিলেই গিয়েছে বিরোধী দলনেতার সুর। সূর্যবাবুর মতে, “শিল্পায়ন নিয়ে সরকার অনেক কথা বলছে। কিন্তু সুযোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের নেতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে। আমরা সরকারে থাকার সময় যা-ই করতাম, ওঁরা তার বিরোধিতা করতেন। এখন সরকারে এসে গিয়েছেন। ইতিবাচক মনোভাব নিন। পুনর্বিবেচনা করুন। আমরা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করব না। এখন সরকার ভেবে দেখুক, কী হারিয়েছি আমরা!” সূর্যবাবুর মতে, সিঙ্গুরের জমি শিল্পের জন্যই ব্যবহার হওয়া উচিত। রাজ্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে কৃষকও জমি ফেরত পায়নি আবার ওই পড়ে-থাকা জমি কোনও কাজে ব্যবহারও হয়নি।
কিন্তু এই শিল্পায়নের পথে যেতে গিয়েই তো নির্বাচনে বামেদের ভরাডুবি হয়েছে? সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সূর্যবাবুর সাফ কথা, “শিল্পায়নের লাইন ঠিক ছিল। শিল্পায়নের বিরোধিতা মানুষ করেননি। নন্দীগ্রাম এবং তার প্রভাবে সিঙ্গুরে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কিছু জটিলতা হয়েছিল, মানুষ সেটা ভাল ভাবে নেননি। কিন্তু শিল্পায়নই একমাত্র পথ। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনও দৃষ্টান্ত নেই। চির কাল এটাই বলেছি, এটাই বলতে থাকব!” |