ঋতিকা। পেশায় ফ্যাশন ফটোগ্রাফার। লিভ-ইন করে। প্রেমিককে খাওয়ায় পরায়। তার ‘ইগো’য় লাগলে বলে ওঠে, “আচ্ছা? মেয়েরা বেশি রোজগার করলে বুঝি ছেলেরা মেরুদণ্ডহীন হয়? এত পড়াশুনো বুঝি এই শিখিয়েছে তোমায়?”
ঈপ্সিতা। পেশায় সাংবাদিক। বিশ্বাস করে, “মনের সম্পর্কে প্রিটেনশন (ভনিতা) অনেক বেশি, তার থেকে শরীরের সম্পর্কই ভাল।” এ নিয়ে তার কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই।
প্রিয়ংকা। স্ব-ইচ্ছায় গৃহবধূ থাকতে চায়। বিয়ের দিন সন্ধেবেলা বান্ধবীকে বলে, “এই কী হবে, আজ যদি মাতাল হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসি? পুরোহিত তো পুরো অজ্ঞান হয়ে যাবে!”
এই তিন কন্যা আজকের প্রজন্মের মেয়ে। এদের ঠিকানা, এ বছরে মুক্তি পেতে চলা প্রথম বাংলা ছবি ‘বেডরুম’।
বাংলা ছবির নায়িকাদের এমন সটান-সপাট-জড়তাহীন অবয়ব কিন্তু ভাবা যেত না কিছু দিন আগে পর্যন্তও। টালিগঞ্জে হালের পরিবর্তনের হাওয়ায় এই ‘বিপ্লব’ সম্ভব হচ্ছে। পথটা অবশ্য দেখিয়েছিল হিন্দি ছবিই। বলিউডে ‘পরিবর্তন’ এসে পড়েছে বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। ছক-ভাঙা কাহিনি নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার সূত্র ধরেই নায়িকার চরিত্রায়ণও বদলাচ্ছে। পেজ থ্রি, লাইফ ইন আ মেট্রো, লাক বাই চান্স, ওয়েক আপ সিড, ইশকিয়াঁ, পা, নো ওয়ান কিলড জেসিকা...তালিকাটা বেশ লম্বা। নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষও এই বদলটা লক্ষ করেছেন। তিনি বললেন, “মূল ধারার ফর্মুলা ছবিতে অনেক দিন পর্যন্ত নায়িকা মানে ছিল, নায়ক যাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে। আর যেই তাকে উদ্ধার করা হল, সেই ছেলেকে ভালবাসা ছাড়া আর কিছু নায়িকার করণীয় আছে বলে মনে করত না কেউ। নায়িকার একটা নিজস্ব পছন্দ-চাহিদার জায়গা যে আছে, এখন সেটা অনেক বেশি করে সামনে আসছে।” |
কী ভাবে এল এই পরিবর্তন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক মৈনাক বিশ্বাস জোর দিলেন, বদলে যাওয়া অর্থনীতি আর শহুরে উচ্চবিত্ত শ্রেণির উত্থানের উপরে। তিনি জানাচ্ছেন, স্বয়ং জাভেদ আখতার কলকাতায় এসে বলে গিয়েছিলেন, ‘প্রযোজকরা এখন বলেই দেন, শহুরে উচ্চকোটির কথা মাথায় রেখেই গল্প লিখতে।’ হিন্দিতে ‘দিল চাহতা হ্যায়’ থেকে যে নতুন ঘরানা জাঁকিয়ে বসেছে, বাংলাতেও এখন তারই জোয়ার লক্ষ করছেন মৈনাক। শাশ্বতীও বললেন, নতুন শহুরে প্রজন্ম তৈরি হওয়া এবং সেই প্রজন্মকে মাথায় রেখে ছবি হচ্ছে বলেই এই জাতীয় বদল অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে।
এমনকী পুরুষ-প্রধান ছবিতেও মাঝে মাঝেই ঝলকে উঠেছে অন্য রকম নায়িকার মুখ। ‘দিল্লি বেলি’তে যেমন নায়িকা দুঁদে সাংবাদিক। বিবাহবিচ্ছিন্ন, কিন্তু তা নিয়ে কোনও প্যানপেনে কান্না নেই। প্রয়োজনে নায়কের সঙ্গে সাহসী শয্যাদৃশ্যের ভান করতেও অসুবিধা নেই। আর, হালের ‘ডার্টি পিকচার’ অবশ্য সব অঙ্ক
বদলে দিয়েছে। যে সিল্কস্মিতা নিজে কোনও দিন প্রকৃত অভিনেত্রীর মর্যাদা পাননি, তার ভূমিকায় দুঃসাহসী অভিনয়ের পরে বিদ্যা বালান, শোনা যাচ্ছে, এখন আর নায়িকা-প্রধান গল্প ছাড়া অভিনয় করবেনই না। খবরটা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন ‘বেডরুমে’র ঈপ্সিতা, ঊষসী চক্রবর্তী। বললেন, “আগে নায়িকা মানেই ছিল ললিতলবঙ্গলতা টাইপের। এতই ভঙ্গুর, নায়ক ছাড়া তার ত্রাণ পাওয়ার জো নেই। মহিলা চরিত্রের এই একপেশে নির্মাণ থেকে বেরনো যাচ্ছে, এটা খুব ভাল কথা।”
শুক্রবার ৩০টা হল-এ মুক্তি পেতে চলেছে যে ‘বেডরুম’, সে একা নয়। নতুন চেহারার নায়িকাদের এখন নিয়মিতই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বাংলা ছবিতে। এর আগে ‘তিন এক্কে তিন’, ‘আমরা’ বা ‘বিষ’-এর মতো ছবি মাঝারি সাফল্য পেয়েছিল। গত বছরের গোড়ায় ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ শোনাল মহিলা রকস্টার-এর গল্প (সেই রঞ্জনা পার্নো মিত্রই বেডরুমের ঋ
তিকা)। ‘২২শে শ্রাবণ’-এ অমৃতা প্রেমিকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে বলে অন্নজল ত্যাগ করল না। অচঞ্চল, সপ্রতিভ ভাবে নতুন করে বাঁচতে শুরু করল। ‘রংমিলান্তি’ ছবির নায়িকা তো আরও এক ধাপ এগিয়ে। পাঁচ বন্ধুকে নানা ভাবে পরীক্ষা করে, রীতিমতো নম্বর দিয়ে তবে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করল সে।
বাংলা ছবির নিরিখে কতটা সাহসী এই পরিবর্তন? মৈনাক মনে করিয়ে দিলেন, সাহসিকতার বিষয়টি স্থান-কাল নিরপেক্ষ নয়। এক সময় উত্তম-সুচিত্রার ‘সাগরিকা’কেও সাময়িকপত্রে অশ্লীল ছবি বলা হয়েছিল। “বস্তুত বিভিন্ন ছবিতে সুচিত্রা সেনকে দেখা যেত, হয় তাঁর মা নেই বা বাবা নেই, বা কেউই নেই। একা একাই তিনি যত্রতত্র আসা-যাওয়া করছেন, চাকরি করছেন! এটা তো কম সাহসের কথা নয়!” নারীর সাফল্যে পুরুষের আহত অহং-এর গল্প কবেই তো উঠে এসেছিল ‘ইন্দ্রাণী’ বা ‘বিলম্বিত লয়ে’র মতো ছবিতে। তা হলে আজকের ছবিগুলো নতুন কীসে? “একটা শ্রেণির মুখপাত্র আগে এ ভাবে হয়ে ওঠেনি বাংলা ছবি।”
বাস্তবিকই শহুরে জেন-এক্সের গল্প, তার জীবনযাত্রা, তার মূল্যবোধই কিন্তু এখনকার ছবির কেন্দ্রবিন্দু। সেই প্রজন্মেরই ‘বেডরুমে’ ঢুকে পড়তে চাইছে ঋতিকা-ইপ্সিতা-প্রিয়ংকার মতো চরিত্র সোজাসাপ্টা কথা বলা, ন্যাকামিবর্জিত মেয়েরা। “বহিরঙ্গে তো বদল অনেক, মনের মুক্তি ঘটছে কি?” প্রশ্ন তুলেছিলেন শাশ্বতী। প্রিয়ংকা-র ভূমিকাভিনেত্রী পাওলি দাম কিন্তু আশাবাদী। বললেন, “কার মনের মুক্তি কতটা, সেটা তো নির্ভর করে তার বড় হওয়া, শিক্ষাদীক্ষা এবং বহির্জগত সম্পর্কে জ্ঞানের উপরে। আমাদের মায়েদের প্রজন্মেও অনেকে ‘মুক্ত’ জীবন কাটাতেন। কিন্তু সংখ্যাটা ছিল অল্প।”দিন বদলেছে, বদলেছে নায়িকার চেনামুখ। এই বদলকে কতটা স্বাগত জানাবে পুরুষ? ‘বেডরুম’, যেখানে মুখোশের কোনও স্থান নেই, সেখানে বদল আসবে কি? |