লোকশিল্প
ছবি: গোপী দে সরকার
রাজা এক জন। কিন্তু রানি থাকবেন ষোলো জন। সুরেঠি নাচের গল্পটি এমনই। দার্জিলিঙের গুরুঙ্গ সম্প্রদায়ের যুবক-যুবতীদের নাচের সঙ্গে থাকবে ঝলমলে পোশাক আর বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র। লড়াই জিতে আসার পর রয়েছে কুকরি নাচ। এটি বীররসের নৃত্য। আর মারনি পরিবেশিত হয় দীপাবলি বা দশেরার সময়। দার্জিলিঙের ‘ত্রিবেণী সঙ্গীতালয়’ দীর্ঘ দিন ধরে দিল্লি, মুম্বই, সিকিম, ভুটান, মিজোরামে এই সব নাচের অনুষ্ঠান করছে। এ বার ওদের গন্তব্য ছিল কলকাতা। বাইপাস সংলগ্ন ছিটকালিকাপুরের লোকগ্রামে। সম্প্রতি সেখানে অনুষ্ঠিত হল সংস্থার ১৭তম বর্ষপূর্তি উৎসব। সেই উপলক্ষে ত্রিবেণী সঙ্গীতালয়ের প্রেম ছেত্রি, রোহিণী ছেত্রি, পূর্বা লেপচা, তারানাথ প্রধান, বা প্রেরণা থেতালরা পরিবেশন করলেন কৌরা, সুরেঠি, পশ্চিমি, মারনি আর গুরুঙ্গ নৃত্য। তিন দিনের এই উৎসবে ছিল নদিয়ার ফকিরি, চব্বিশ পরগনার পুতুল নাচ, উত্তর দিনাজপুরের মুখা নাচ, দক্ষিণ দিনাজপুরের দং, সহরায় ও লাগাড়ে, মালদার গম্ভীরা, পুরুলিয়ার বুলবুলি নাচ, বাঁকুড়ার ঝুমুর, বা বর্ধমানের রণপা নৃত্যের মতো লোকসংস্কৃতির নানাবিধ উজ্জ্বল উপাদান। জনজাতিদের লোকজ উপাদানগুলি বাঁচিয়ে রাখতে সারা বছর ধরে সচেষ্ট লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের উদ্যোগে তাই ফি-বছর হয়ে থাকে এই অনুষ্ঠান। সম্প্রতি নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য ওরা আয়োজন করেছিল গুরুকুল প্রকল্প। শিক্ষান্তে শিক্ষার্থীরা এখানকার মঞ্চে নিবেদন করল তাদের সৃষ্টিসম্ভার। এর মধ্যে ছিল পুরুলিয়ার গুণধর সহিসের নাটুয়া, উত্তর দিনাজপুরের শচীন সরকারের মুখা নাচ এবং জলপাইগুড়ির বলরাম হাজরার ঢোলবাদ্য। দুবরাজপুরের তালপাতার হাতপাখা, দিনাজপুরের শিল্পীদের বাঁশখোদাই আর মেদিনীপুরের পটুয়াদের আঁকা প্যানেলে সেজেছিল লোকগ্রাম। যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন প্রতি দিন।

শতবর্ষে লোককবি
নাম তাঁর নিবারণ পণ্ডিত। গণসঙ্গীতের অন্যতম স্রষ্টা। জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার সগড়া গ্রামে ১৯১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। বাবার শিক্ষকতার সূত্রে প্রাপ্ত উপাধি ‘পণ্ডিত’। প্রকৃত অর্থেই তিনি বাবার গুণাবলি পেয়েছিলেন। তাই কৈশোরে পিতৃহারা বালক মুখে মুখে কবিতা গান রচনা করতেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। সংসারের অবস্থা খারাপ হওয়ায় পড়াশুনো শেষ করতে পারেননি। জনসভায় গ্রামের গায়ক-বাদকদের দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে রচনা করতেন গান-কবিতা। শ্রমজীবী মানুষদের কাছ থেকে দেখে, তাঁদের সঙ্গে মিশে এক সময় একাত্ম হয়ে গেলেন। এ ভাবেই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাতায়াত। কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক আন্দোলনে যোগদান। এর আগে ১৯১৪-য় ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা গান তাঁকে পরিচিতি দেয়। ১৯৪৫-এ নেত্রকোনায় (ময়মনসিংহ) সারা ভারত কৃষক সভা উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে প্রচার করেন। ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্টদের ওপর অত্যাচার করত, তার শিকার হয়েছিলেন নিবারণবাবুও। ১৯৫০-এ ভারতে চলে এসে আস্তানা করেন কোচবিহার শহরের কাছে ডাউয়াগুড়ি গ্রামে। আমৃত্যু (১৯৮৪) যোগাযোগ ছিল প্রবাদপ্রতিম গণসঙ্গীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে। দু’জনে যেন ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। ২৯ এপ্রিল, ১৯৫১-য় কোচবিহার শহরে ভুখা মিছিলের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে পাঁচ জন শহিদ হন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে রচিত তাঁর গান প্রবল আলোড়ন তুলেছিল সে সময়। নিবারণ পণ্ডিত কোনও দিন সরকারি সাহায্য নেননি। শুধুমাত্র ভারত সরকারের সমাচার চিত্র তাঁর ওপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিল। লোককবি নিবারণ পণ্ডিত আজ সবার কাছে বিস্মৃত। নীরবে সমাপ্ত হতে চলল তাঁর জন্মশতবর্ষ। এই উপলক্ষে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে শিল্পীকে স্মরণীয় করে তুলতে এখনও কোনও উদ্যোগ নজরে পড়ল না, এটাই দুঃখের।

মাইজি
স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা নিঃস্বার্থ ভাবে দেশ সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম দিনাজপুরের বেলারানি চট্টোপাধ্যায়। সকলের কাছে তিনি ‘মাইজি’ নামে পরিচিত ছিলেন। বেলারানি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে (১২ চৈত্র ১৩১৭) ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বনেদি পরিবারের মেয়ে। বাবা রেবতীমোহন চক্রবর্তী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার জেলা জজ। দেশ সেবার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। বাবার এই দেশাত্মবোধক মনোভাব বেলারানিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। মাত্র তেরো বছর বয়সে বালুরঘাটের বিশিষ্ট চিকিৎসক সুনীলরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সুনীলরঞ্জন ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী। বেলারানি জাতীয় কংগ্রেসের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সামাজিক উন্নয়নের কাজও শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনে তিনি রাজলক্ষ্মী গুহ, প্রভা চট্টোপাধ্যায়, বড়-জা কুমুদকামিনী দেবী প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে মদের দোকানে পিকেটিং, বিলেতি কাপড় পোড়ানো, বিদেশি বস্ত্র বর্জন ইত্যাদি করতেন। এই ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তাঁকে বেশ কয়েকবার কারাবন্দি হতে হয়। প্রথমে দিনাজপুর জেলে বন্দি ছিলেন। এর পর তাঁকে হিজলি জেলে পাঠানো হয়। যখন বেলারানির দ্বিতীয় পুত্রের বয়স মাত্র দুই বছর, তখন তাঁকে বন্দি করা হয়। শিশুপুত্রের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়নি। ’৪২-এর আন্দোলনেও বেলারানি সক্রিয় ভূমিকা নেন। বালুরঘাটে ‘মহিলা সমিতি’ স্থাপনে বেলারানি দেবীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মেয়েদের লাঠিখেলা, অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মহিলা সমিতি মেয়েদের দিয়ে রুমাল, গামছা, লুঙ্গি প্রভৃতি তৈরি করিয়ে বাজারে বিক্রি করতো। এ ছাড়া বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থাও করেছিল। মহিলাদের দিয়ে সাপ্তাহিক বাজার প্রচলন মহিলা সমিতির উল্লেখযোগ্য কাজ। বেলারানি, প্রভাবতী দেবী মহিলাদের বাড়িতেই নানা রকমের ফল বা ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করতেন। উৎপাদিত কুমড়ো, লাউ, পেঁপে, শাক-সব্জি ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা সপ্তাহে এক দিন একত্র হয়ে বিক্রি করতেন। ওই মহিলা মেলাই ‘মণিমেলা’ নাম নেয় যা আজও জনপ্রিয়। মহিলা সমিতির আড়ালে মহিলারা সে সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নানা তথ্য আদানপ্রদান করতো। বেলারানি ব্যক্তিগত ভাবে বহু পরিবারকে নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন। বালুরঘাট হাইস্কুল, বালুরঘাট মহিলা কলেজ ও অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মূলে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তাঁর সামাজিক কাজকর্মের জন্যই দলমত নির্বিশেষে তিনি সকলের কাছে মাইজি। এই জেলাকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন। তাই বালুরঘাট ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার চেষ্টা তিনি কোনও দিন করেননি। ২০০২-এ মাইজি পরলোকগমন করেন।


উত্তরের কড়চা
এ বি পি প্রাঃ লিমিটেড
১৩৬/৮৯ চার্চ রোড
শিলিগুড়ি ৭৩৪৪০১



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.