|
|
|
|
অসিযুদ্ধ |
লক্ষ্মণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল |
গৌতম ভট্টাচার্য • সিডনি |
টস হতে সামান্য দেরি। সিডনির চার তলার প্রেসবক্সে ঢুকে দেখলাম, বড় করে বিজ্ঞপ্তি টাঙানো পাসেস ফর কালেকশন। নামে নামে চল্লিশটারও বেশি প্রেস পাস বোর্ডে ঝুলিয়ে রাখা। নীচে লেখা, একমাত্র উপযুক্ত পরিচয়পত্র দাখিল করলে তবেই পাস তোলা যাবে। রীতিমতো অবাক লাগল। এমন ঐতিহাসিক আর অভিজাত টেস্টের আগে মিডিয়ার এত লোক পাস তোলেনি! আর কখন তুলবে বাবা। টস তো হতে চলল!
এ বার চরম বিস্ময়! নামগুলোর দিকে চোখ পড়ায়। সি বি ফ্রাই, রবার্টসন গ্লাসগো, রে রবিনসন, লিন্ডসে হ্যাসেট, নেভিল কার্ডাস, জন আর্লট। সবশেষে পিটার রোবাক! আরে সবাই তো মৃত! অশরীরীদের প্রেস পাস তুলতে বলা হচ্ছে, এটা অপ্রস্তুত মনে দড়াম করে ধাক্কা তো নিশ্চয়ই। প্রথম দিনের ক্রিকেট দেখে মনে হচ্ছে, আইডিয়াটা চুরি করা উচিত ডানকান ফ্লেচারের। ভারতীয় ড্রেসিংরুমে এ বার তিনিও একটা বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দিন: সিডনি টেস্টের কিছু বক্স টিকিট সুইং-সিম বোলিং খেলতে পারদর্শী ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপ যেন উপযুক্ত পরিচয়পত্র দেখিয়ে সংগ্রহ করে নেয়।
টিকিট নিতে কেউ আসবে না। কারণ, সুইং-সিম খেলতে পারদর্শী সেই ইউনিটটা রোবাকের বর্তমান অধিষ্ঠানেই চলে গিয়েছে। অশরীরী হয়ে।
সকালে খেলা শুরুর বেশ আগে দেখলাম মহিলা অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী এসে পড়েছেন। সিডনি মাঠের সংস্কারের জন্য অস্ট্রেলীয় সরকার যে প্রচুর ডলার দিচ্ছে সেটার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্যই তিনি এসেছিলেন। থেকে গেলেন তার পরে অনেকক্ষণ। কেন জানি না মনে হল, কূটনৈতিক পর্যায়ে এখন ভারত-অস্ট্রেলিয়া এত ভাল সম্পর্ক যে, নিজের বাড়ির বাইরে টিমকে দাঁড় করিয়ে রাখা নিয়ে যে বিতর্ক অস্ট্রেলীয় দৈনিকেও ছড়িয়ে পড়েছে তাকে এতদ্বারা সমাধিস্থ করে গেলেন। শুনলাম, অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড-ও কোনও একটা বক্সে। প্রাক্তন গণ্যমান্য ক্রিকেটারদের ভিড় তো সিডনি টেস্টের প্রথম দিনে থাকেই থাকে। এমন রাজসমাবেশ। ধোনি টস জিতলেন। তা-ও এমন গরমের দিনে যাকে টিভি প্রেজেন্টার আখ্যা দিচ্ছেন, ভুল করে ক্রিকেট ডে। হওয়া উচিত বিচ ডে। প্রচুর ভারতীয় সমর্থক এসে পড়েছে। সিডনিজাত স্বামী-আর্মি তো আছেই। ভারতীয় সমর্থকদের প্রথম রেজিস্টার্ড এই গোষ্ঠী আজ ঢাক এনেছে। সঙ্গে শাঁখ। এত রোদ্দুর মানে বল বেশি নড়বে না। সিডনি উইকেট এমনিতেই নিচু বাউন্সের। সহবাগের কথায় নিরুপদ্রবে কাটাতে হবে তো মাত্র দেড়খানা সেশন। তার পর অস্ট্রেলিয়া, তোমার এক দিন কী আমাদের এক দিন! |
|
কিংবদন্তিদের সম্মান জানাতে এসসিজি-তে জন আর্লট, নেভিল কার্ডাস,
পিটার রোবাকদের নামেও মরণোত্তর প্রেস পাস। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য |
সেই টিম ৫৯ ওভারে ভেঙে পড়াতে আলোচনা শুরু হয়ে গেল, ভারত কি আর তিনশো করবে না ঠিক করেছে? বিদেশে গত এগারো ইনিংসে এক বার মাত্র তিনশো হয়েছে। ভাষ্যকারদের বক্স থেকে কে একজন শুনে এলেন, বাকি সিরিজে ভারত তিনশো করলে রাখি সাওন্ত বলেছেন জুহু বিচে নগ্ন হয়ে দৌড়াবেন।
চার বছর আগেও যে ব্যাটিং লাইন আপ সুইং আর সিম সামলে ইংল্যান্ডের বুকে সিরিজ জিতেছে তারা তো সত্যিই অশরীরী হয়ে পড়েছে। কোহলির বদলে সৌরভ। গৌতম গম্ভীরের পরিবর্তে ওয়াসিম জাফর। এই তো ছিল।
সেই ইউনিট আচমকা এত বৃদ্ধ হয়ে গেল কী করে? সবচেয়ে করুণ অবস্থা ভিভিএস লক্ষ্মণের। সিরিজে রান করেছেন ২,১,২। যন্ত্রণাটা নিছক কম রানকেন্দ্রিক হতাশা নয়। কম রান তো ধারাবাহিক ভাবে আসতেই পারে। কিন্তু লক্ষ্মণ বিদেশের মাঠে জুলাইয়ের সেই ইংল্যান্ড সিরিজ থেকে পরপর এমন আউট হচ্ছেন যাতে পরিষ্কার মনে পড়ছে সেই বিখ্যাত গানের লাইন ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন’। গুজব রটছে যে, সিডনিতে দ্বিতীয় ইনিংসেও রান না পেলে বোর্ড তাঁকে অবসর নিতে বাধ্য করবে।
উড়ো খবরটা সত্যি কি না জানি না। কিন্তু লক্ষ্মণকে যে অস্ট্রেলিয়া লালুভুলুর মতো আউট করছে এটা দেখতে কদর্য লাগছে। আর গম্ভীর তাঁর তো কোনও আত্মবিশ্বাসই অবশিষ্ট নেই। গত দশ টেস্টে ভারত যে ওপেনিংয়ে একটা হাফসেঞ্চুরি পার্টনারশিপও করতে পারেনি তার কারণ, গম্ভীরের ব্যর্থতা। যা সেই কবে থেকে চলছে। সহবাগ? তিনি ধৈর্য ধরে আজ ক্রিজে পড়েছিলেন। কিন্তু বল যেখানে সারাক্ষণ সিম করে। সুইং করে। যে পিচে শটে পা নিয়ে যেতেই হবে, সেখানে সহবাগকে প্রায়ই অসহায় লাগে। যেখানে অসহায় লাগে না, সেখানে চরম অনিশ্চিত। আজ তাঁর সহজ ক্যাচ যখন পন্টিং স্লিপে ফেললেন, মনে হয়েছিল এই তো খেলার মোড় ঘুরে গেল। কিন্তু সুযোগ কাজেই লাগাতে পারলেন না বীরু। সাত বছর আগে সৌরভের দলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া সফরে এসে দুর্দান্ত ১৯৫ করেছিলেন মেলবোর্ন টেস্টে। কিন্তু সে বারের পিচগুলো তুলনায় অনেক শুকনো ছিল। বল বাউন্স করত। এত সিম করত না। হাওয়াতে এত ভাঙত না। এ বার সিডনির মতো মাঠেও সারাদিন বল সুইং করল। এর উত্তরে রাহুল দ্রাবিড় সিরিজ শুরু করেছিলেন ভাল। কিন্তু এখন আবার মানসিক সুড়ঙ্গে ঢুকে যাচ্ছেন। এ দিন ৩৩ বল খেলে দ্রাবিড় করলেন মাত্র ৫। বিরাট কোহলি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সিমিং উইকেটের জন্য তাঁর টেকনিক এখনও তৈরি হয়নি। ধোনি আনতাবড়া চালিয়ে অপরাজিত থাকলেন কিন্তু রানটা কোথায় বড় হল!
বরং ভারতের কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যাটসম্যানের ইংল্যান্ড থেকে পরপর ইনিংস দেখে মনে হচ্ছে, এঁরা ব্যাটিংয়ে বিশেষ কৃতিত্বের দেশজ এমডি ডিগ্রি যে প্রত্যেকেই করেছেন অনস্বীকার্য। কিন্তু সঙ্গে এফআরসিএস কেবল মাত্র সচিন আর দ্রাবিড়। ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে যেমন ডিগ্রি লেখা থাকে, তেমনই এঁদের পাশেও মোট রান বা গড়ের সঙ্গে যাঁর যাঁর ডিগ্রি নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। কারা কারা উপমহাদেশেরই নিছক মস্তান। কাদের কাদের সব পরিবেশের জন্য ‘এফআরসিএস’ রয়েছে।
তেন্ডুলকরের দুটো ডিগ্রিই আছে। কিন্তু তিনি নিজের ওপর তৈরি প্রাণান্তকর চাপের শিকার হচ্ছেন বারবার। একে তো শততম সেঞ্চুরির দাবি তাঁর ওপর। এর সঙ্গে উল্টো দিকে পরের পর উইকেট পড়ে যাচ্ছে। মেলবোর্ন থেকে সিডনি। তিন ইনিংসে তাঁর রান যথাক্রমে ৭৩, ৩১ আর ৪১। গড় ৪৮। তিন বারই দারুণ শুরু করে সচিন হঠাৎ থমকে গেছেন। এ দিন রিচি বেনো বলছিলেন, “সচিনের সমস্যা হল কিছু দূর গিয়ে ও বুঝতে পারছে না কী ভাবে খেলবে। অ্যাটাক করবে, না কি দলের কথা ভেবে এক দিক ধরে রাখবে। এই দোনোমোনোয় পড়ে ওর ইনিংসগুলো দুর্দান্ত শুরু হয়েও হারিয়ে যাচ্ছে।”
বারবারই সচিনকে হারিয়ে খেলার কর্তৃত্ব তুলে নিচ্ছেন মাত্র চার টেস্ট খেলা জেমস প্যাটিনসন। অথচ সচিনের যে বছর ম্যাঞ্চেস্টারে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, সে বছর জন্মান প্যাটিনসন। একুশ ছুঁইছুঁই বয়সে কী বলটাই না তিনি সিরিজে করছেন। অস্ট্রেলিয়ার তিন পেসারই টানা একটা নির্দিষ্ট লাইনে বল করছেন। অফস্টাম্প ও তার সামান্য বাইরে। লেগ বা মিডল স্টাম্পে পারতপক্ষে নয়। মাঝে মধ্যে শর্ট করে করে ব্যাটসম্যানদের ব্যাকফুট করে দিচ্ছেন। আপনিই পরের বল ফ্রন্টফুটে এসে তারা দেখছে বল কানা নিয়ে চলে গেল। ড্রাইভের বল পারতপক্ষে থাকছে না। পুল করার লেংথে বল নেই। বাইরে বল করে করে রানটা আসলে ‘চোক্’ করে দেওয়া হয়েছে। কী ভাবে উত্তর দেওয়া হবে এর? কে ভাঙবে অস্ট্রেলীয় চোকিং স্ট্র্যাটেজির অচলায়তন? এখনও পরিষ্কার নয়।
ভারত ফিল্ডিং করার সময় প্রথম স্লিপ থেকে অনবরত বোলারদের চাগিয়ে গেলেন সচিন। পরপর উইকেটও পড়ল ক্লার্কদের এবং শুরুতে মনে হচ্ছিল, ভারত প্রত্যাঘাত করছে। সচিন আজ বোলারদের সঙ্গে টানা এত কথা বলছিলেন কারণ, তিনি ভালই বুঝছেন যে, বুধবার যদি অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে বড় রানে এগিয়ে যায়, তা হলে তাঁদের সিরিজ জয়ের শপথ স্ট্রেট প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পড়বে!
সমস্যা হল, চেঁচিয়ে কি আর পন্টিংদের হারানো যায়? জেমস প্যাটিনসনের করে দেওয়া জায়গাটা সিডল-হিলফেনহসরা চমৎকার বজায় রেখেছেন। এখানে জাহিরের তৈরি চাপ হালকা করে দিলেন ইশান্তরা।
সিডনির প্রথম দিন দুপুর-দুপুরেই দুটো জিজ্ঞাসা ছিল।
১) খেলা তিন দিনেই শেষ, না চার দিন টানবে?
২) সিরিজটাও কি সেই ইংল্যান্ডের মতোই ০-৪? না কি একটা ড্র হলেও হতে পারে? ০-৪ নয়, সে ক্ষেত্রে ০-৩ অপেক্ষা করে আছে!
|
সিডনির স্কোর |
ভারত
প্রথম ইনিংস: |
গম্ভীর ক ক্লার্ক বো প্যাটিনসন ৯
সহবাগ ক হাডিন বো প্যাটিনসন ৩০
দ্রাবিড় ক কাওয়ান বো সিডল ৫
তেন্ডুলকর বো প্যাটিনসন ৪১
লক্ষ্মণ ক মার্শ বো প্যাটিনসন ২
কোহলি ক হাডিন বো সিডল ২৩
ধোনি নঃআঃ ৫৭
অশ্বিন ক ক্লার্ক বো হিলফেনহস ২০
জাহির ক কাওয়ান বো হিলফেনহস ০
ইশান্ত ক কাওয়ান বো হিলফেনহস ০
উমেশ ক হাডিন বো সিডল ০
অতিরিক্ত ১৩,
মোট ৫৯.৩ ওভারে ১৯১।
পতন: ০, ৩০, ৫৫, ৫৯, ৯৬, ১২৪, ১৭৮, ১৭৮, ১৮৬।
বোলিং: প্যাটিনসন ১৪-৩-৪৩-৪, হিলফেনহস ২২-৯-৫১-৩,
সিডল ১৩.৩-৩-৫৫-৩, হাসি ২-০-৮-০, লিয়ঁ ৮-০-২৫-০। |
অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস: |
ওয়ার্নার ক তেন্ডুলকর বো জাহির ৮
কাওয়ান এলবিডব্লিউ জাহির ১৬
মার্শ ক লক্ষ্মণ বো জাহির ০
পন্টিং ব্যাটিং ৪৪,
ক্লার্ক ব্যাটিং ৪৭
অতিরিক্ত ১,
মোট ২৬ ওভারে ১১৬-৩।
পতন: ৮, ৮, ৩৭।
বোলিং: জাহির ৯-২-২৬-৩, উমেশ ৮-১-৪২-০, ইশান্ত ৬-০-৩০-০,
অশ্বিন ২-০-১১-০, সহবাগ ১-০-৬-০। |
|
|
|
|
|
|
|