বণিকসভা ‘ফিকি’ একটি গুরুতর প্রশ্ন তুলিয়াছে। আমরি হাসপাতালের পরিচালকমণ্ডলীর কয়েক জন সদস্যকে যে ভাবে আটক করিয়া রাখা হইয়াছে, ফিকি’র প্রশ্ন তাহা লইয়াই। বণিকসভার বক্তব্য, বিচারে যাঁহারা দোষী সাব্যস্ত হইবেন তাঁহাদের আইনানুগ শাস্তি অবশ্যই প্রাপ্য, কিন্তু এখন বিচারপ্রক্রিয়া চলিতেছে, সুতরাং যাঁহারা হাসপাতালের দৈনন্দিন পরিচালনায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন না তাঁহাদের আটকাইয়া রাখা ঠিক নয়। এই বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত। বস্তুত, যুক্তি অনুসরণ করিয়া যত দূর যাওয়া বিধেয়, ফিকি তাহার তুলনায় অনেক কম গিয়াছে। প্রথমত, হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের নৈতিক দায়িত্ব অবশ্যই তাহার পরিচালকদের উপর বর্তায়, কিন্তু কেবল নৈতিক দায়িত্বের কারণে কাহাকেও গ্রেফতার করা সচরাচর বিহিত বলিয়া গণ্য হয় না, সে জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কার্যনির্বাহী ভূমিকা থাকা দরকার হয়। আমরির ক্ষেত্রে যাঁহাদের আটক করা হইয়াছে, তাঁহাদের সকলেরই কি হাসপাতালের দৈনন্দিন পরিচালনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল? বিপরীত দিকে, যাঁহাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, সুতরাং দায়িত্ব ছিল, তেমন সকল কর্তাব্যক্তিকেই কি গ্রেফতার করা হইয়াছে? ন্যায়বিচার এই প্রশ্নগুলির সন্তোষজনক উত্তর দাবি করে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কোনও অপরাধের দায়ে যাঁহাকে গ্রেফতার করা হইতেছে, তাঁহাকে জামিন দেওয়া হইবে না কেন? ভারতীয় দণ্ডবিধির মূল আদর্শ সুবিদিত: কাহারও বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যতক্ষণ প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ আইনের চোখে তিনি নিরপরাধ। ‘বিচারাধীন কয়েদি’র ধারণাটি এই আদর্শের পরিপন্থী। বিচারাধীন হইলে কয়েদ করিয়া রাখা হইবে কেন? কেন গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে যথাসম্ভব দ্রুত জামিন মঞ্জুর করা হইবে না? ‘হেবিয়াস কর্পাস’ নামক গুরুত্বপূর্ণ নীতিটি কিন্তু মূলত এই কথাই বলে। এই নীতি অনুসারে, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে কয়েদ রাখা হইবে কি না, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত বিচারকেরই এক্তিয়ারে, কিন্তু আইন জামিন নামঞ্জুর করিবার অধিকার দিয়াছে বলিয়াই যদি জামিন না দেওয়া হয়, তাহাতে আইনের অক্ষর বাঁচে, আত্মা বাঁচে না। সন্ত্রাসবাদের মতো অতি-বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া, অথবা জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তি সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপ বা বিকৃত করিতে পারিবেন, এমন কথা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ না থাকিলে অবিলম্বে জামিন দেওয়াই বিচারধারার অঙ্গ হওয়া উচিত। বস্তুত, পশ্চিম দুনিয়ায় এই রীতিই স্বাভাবিক ভাবে আচরিত। গত বছরে বিশিষ্ট ম্যানেজমেন্ট বিশারদ রজত গুপ্ত আর্থিক অনাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হন। মার্কিন আদালতে হাজির হইবার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জামিন পাইয়া যান। ইহা সে দেশে কোনও ব্যতিক্রম নয়, ইহাই রীতি।
ভারতে বিপরীত রীতিই সচরাচর প্রচলিত। এবং এক দিকে অতিবিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়া, অন্য দিকে দীর্ঘ দিন জামিন না দিয়া কয়েদ রাখা দুইয়ে মিলিয়া যে পরিণতি দাঁড়ায়, তাহাকে ‘বিচারের আগেই শাস্তিদান’ বলিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। লক্ষণীয়, বিচার অতিমাত্রায় বিলম্বিত বলিয়াই এ দেশের জনসমাজে জামিন না দিয়া কয়েদ রাখিবার রীতিটি এক ধরনের অনুমোদন পাইয়া গিয়াছে। বিশেষত, অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি ক্ষমতাবান বর্গের মানুষ হন, তদুপরি সামাজিক পরিচয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হইতে কিছুটা দূরবর্তী হন, তাঁহাকে কয়েদ থাকিতে দেখিলে সাধারণ মানুষ অনেক সময়েই এক ধরনের পরিতৃপ্তি বোধ করেন, ভাবেন ‘বেশ হইয়াছে’। আমরি’র ক্ষেত্রে এই ‘প্রতিশোধ’মূলক মানসিকতার লক্ষণ দুর্নিরীক্ষ্য নয়। আশঙ্কার কথা, প্রশাসনের পরিচালকদের কথাবার্তাতেও কখনও কখনও এই মানসিকতার এক ধরনের সমর্থন মিলিতেছে। ইহা কেবল অনৈতিক নয়, ইহা উদ্বেগজনক। আইনের শাসনে প্রতিশোধের কোনও স্থান নাই। |