নদীর চরে মাটি ফেলে ইতিমধ্যেই সাগরদ্বীপে নতুন একটি বন্দর গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ। একই পদ্ধতিতে রাজ্যে আরও কয়েকটি ছোট-মাঝারি বন্দর গড়ে তোলা যায় কি না, সে ব্যাপারে সমীক্ষার কাজ শুরু করেছে বন্দর কর্তারা। বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ওই প্রকল্পগুলিও গড়ে তোলা হবে।
রাজ্যে নতুন সরকার এসে জমি অধিগ্রহণ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আবার বাজার থেকেও সরাসরি জমি কিনতে গেলে নানা রকম জটিলতা তৈরি হয়। এ ছাড়াও সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ঘটনার পর থেকে রাজ্যের সর্বত্রই প্রকল্পের জন্য সহজে জমি পাওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছে বলে বন্দর কর্তাদের অভিমত। তাই নদীর পাড়ে পলি জমে যে চর তৈরি হয়েছে, বিকল্প উপায় হিসাবে তা পুনরুদ্ধার করেই বন্দর নির্মাণের জন্য বেশ কয়েকটি জমি তৈরি করে রাখতে চাইছে সংস্থা কতৃর্পক্ষ।
কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান মদনলাল মিনা জানান, বঙ্গোপসাগর থেকে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে জাহাজ ঢোকার প্রায় ১১০ কিলোমিটার জলপথের পলি মাটি তুলে, নদীর গভীরতা বজায় রাখতে হয়। নদীর পাড় ধরে চর বরাবর ওই মাটি ফেলেই নতুন বন্দরগুলির জন্য জমি তৈরি করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে কোনও জমি কেনা বা অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে না। পরিকল্পনাটি রূপায়িত করতে বন্দরের অভিজ্ঞ কর্মীদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন হয়েছে বলে তাঁর দাবি। মিনা বলেন, “এমন ভাবে প্রকল্পগুলির নকশা ভাবা হচ্ছে, যাতে একই জমিতে বন্দরের সঙ্গে ছোট-ছোট শিল্পাঞ্চলও গড়ে তোলা যায়।” |
বছর খানেক আগেই কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ, পূর্ব মেদিনীপুরের সালুখালি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ডহারবারে দু’টি মাঝারি মাপের বন্দর গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল, কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের চাপ কমানো। কিন্তু সালুখালি ও ডায়মন্ডহারবার, ওই দু’টি প্রকল্পই গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নানা জটিলতা। সম্প্রতি সেই সমস্যা মিটলেও, প্রকল্পের প্রাথমিক কাজগুলি শুরু করতেই অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই কারণেই অন্যের জমির উপর নির্ভর না করে, নিজেদের অধীনে থাকা জমিকেই সঠিক ভাবে ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে।
কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে জাহাজ ঢোকার জলপথগুলির নাব্যতা বজার রাখতে সারা বছরই বন্দর কর্তৃপক্ষকে পলি মাটি তুলে ফেলতে হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওই মাটি ফেলার নির্দিষ্ট কোনও জায়গা না থাকার ফলে, নদীর পাড়েই তা জমতে থাকে। বর্ষার সময় ওই মাটিই আবার জলে ধুয়ে নদীতে মিশে যায়। বন্দর কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ওই মাটি যদি প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত করা চরগুলিতে ফেলা যায়, সে ক্ষেত্রে বন্দরের জমিও তৈরি হবে, আবার মাটিও জলে ধুয়ে ফের নদীর সঙ্গে মিশবে না।
বন্দরের এক কর্তা জানান, সাগরদ্বীপ ছাড়াও, কলকাতা বন্দরের অধীনে থাকা নদী এলাকার মধ্যে এ রকম বহু চর জমি রয়েছে, যেখানে কেবল জোয়ারের সময়ই সামান্য জল ঢোকে। কিছু কিছু অঞ্চলে আবার প্রাকৃতিক কারণেই পলি জমে-জমে, অনেকটাই ভরাট হয়ে গিয়েছে। ওই জমি গুলির উপরেই মাটি ফেলে উঁচু করে ফেলা সম্ভব। বন্দরের নতুন কমিটি ইতিমধ্যেই ওই অঞ্চলগুলিকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে বলে কর্তাদের দাবি।
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মতো, নতুন প্রকল্পগুলিতেও একশো ভাগ লগ্নি করবে বেসরকারি সংস্থাগুলি। বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু জমি ও অন্যান্য প্রশাসনিক সহযোগিতা করবে। আর ব্যবসা থেকে যে লাভের টাকা আসবে, তা কী অনুপাতে পরস্পরের মধ্যে ভাগাভাগি হবে, সেটা ঠিক করে দেবে যোজনা কমিশন। এই মডেলেই এখন প্রতিটি রাজ্যে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে নতুন বন্দর গড়ে উঠছে।
কিন্তু নদীর উপর বন্দর গড়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রকের বিভিন্ন বিধি-নিষেধ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্পের জন্য ছাড়পত্র মিলবে কি? মিনার দাবি, “পশ্চিমবঙ্গে নদীর পাড়ে বন্দর গড়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। যে কারণে সালুখালি এবং ডায়মন্ডহারবার প্রকল্পের জন্যও পরিবেশ রক্ষা করেই নকশা তৈরি করা হয়েছিল এবং মন্ত্রক তার ছাড়পত্রও দিয়ে দিয়েছে। নতুন বন্দরগুলির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম মেনে চলা হবে।”
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রক অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশার মতো উপকূলবর্তী রাজ্যগুলিকে নতুন বন্দর গড়ে তোলার ব্যাপারে দ্রুত পরিকল্পনা রূপায়নের কথা বলেছে। কারণ মন্ত্রকের হিসেব মতো, সামনের বছর থেকে যে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হচ্ছে, তাতে দেশের বন্দর শিল্পে বেসরকারি সংস্থাগুলির সম্মিলিত বিনিয়োগের বহর হতে পারে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই লগ্নিই গুজরাত, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর মতো উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও নতুন বন্দর প্রকল্পে আসতে পারে। আর সে কথা মাথায় রেখেই কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ সাগরদ্বীপ ছাড়াও অন্য অঞ্চলেও জমি পাওয়ার পথ পরিষ্কার রাখতে চাইছে। |