এ বছর অনেক বিরাট মাপের মানুষ আমাদের ছেড়ে গেছেন। এক জন পুরুষ ছিলেন যিনি ভারতের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন্সি করেছেন একটা চোখ নিয়ে। মনসুর আলি খান পটৌডি। তাঁকে ভালই চিনতাম। তাঁর স্ত্রী-কে, ছেলেকে, কন্যাদেরও আমি খুব ভাল ভাবে চিনি। শাম্মিজি চলে গেলেন। ভীষণ বেদনার সঙ্গে লম্বা লড়াই করছিলেন এত দিন। আমার বন্ধু ছিলেন। তারপর জগজিৎজি গেলেন। ওঁকে চিনতাম, ওঁর স্ত্রীকেও। ওঁদের জীবনে একটা বিরাট ট্র্যাজেডি ছিল। ছেলে মারা গিয়েছিল খুব কম বয়সে। আর দেবসাব-এর মৃত্যুটা তো মেনেই নিতে পারছি না। সীমাহীন এনার্জি থাকা একটা লোক কী ভাবে যে চলে গেল! মন কিছুতেই মানতে চায় না। স্টিভ জোবসকে অবশ্য চিনতাম না। কিন্তু যাঁরা আমাদের ছেড়ে গেলেন, এঁদের সকলের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিল। এঁরা সকলে জীবনের ছুড়ে দেওয়া প্রত্যেকটা সুযোগকে আলিঙ্গন করেছিলেন। প্রত্যেকের জীবনে দুঃখ ছিল, বিরাট বিরাট ক্ষতও ছিল। তা সত্ত্বেও ঝাঁপিয়েছিলেন। এই সব জীবন থেকে আমি খুব দরকারি একটা জিনিস শিখেছি। জীবনে একটা ভুল কাজ করলে, আমায় আবার সেই কাজটাই করতে হবে। আমি এখানে খুব শিশুসুলভ। একটা কাজ করেছি। ভুল করেছি। আবার সেই কাজটাই করব। এবং ঠিক করব।
আসলে মৃত্যুটাই জীবনের সবচেয়ে মহৎ ঘটনা। সত্যি বলতে, আমি যে একদিন মারা যাব, এই চিন্তাটাই আমায় নতুন নতুন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে প্রতিদিন। বাবা-মা মারা যান খুব ছোট বয়সে। তাই মৃত্যুকে ভয় পাই না। ওপরওয়ালা তো ওই একটা কথাই আমাদের পরিষ্কার বলেছেন যে মৃত্যু আসবেই। জীবন সম্বন্ধে আর কিছুই খোলসা করেননি। অথচ দেখুন, যেটা নিশ্চিত ঘটবে, সেটাকেই ভুলে অন্য সব কিছুর জন্য আমরা লড়াই করে যাচ্ছি।
সারা ক্ষণ এই ভাবনায় বুঁদ হয়ে আছি যে আরও কত দিন বাঁচব, কত সুস্থভাবে বাঁচব। শেষে যে সব চেষ্টাই মিথ্যে হয়ে যাবে ভাবছিই না! এই যে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই অবশ্যম্ভাবী নয় জীবনে, ওপরওয়ালার এটা কিন্তু একটা গোপন বার্তা। যেন বলতে চাইছেন যত দিন আছ, যা, যা করার করে নাওরিস্ক নাও, ভুল করো। কারণ মাঝে মাঝে একটা ভুলও না করে কোনও কোনও জীবন শেষ হয়ে যায়। বড় সাবধানী সে সব জীবন। তাই ভুলও করো, ঠিকও করো। সুযোগ নাও। হোঁচট খাও। আর সারাক্ষণ মাথায় রাখো এর কোনওটাই তোমার সঙ্গে চিরদিন থাকবে না। দেখেছি তো এ সব ঘটতে। তাই বন্ধুবান্ধবদের বলি, আমার ছেলেমেয়েকে বলি, স্ত্রীকে বলি যে আমাকে যে কোনও দিন চলে যেতে হতে পারে... মাঝে, মাঝে ওরা বুঝতে পারে না... মনে করে আমি দার্শনিক কথাবার্তা বলছি।
কে বলতে পারে ওই দরজাটা পেরিয়ে পাশের ঘরে গেলে আমি জীবিত থাকব কি না? সে জন্যই সবাইকে বলি প্রতি মুহূর্তের জন্য বাঁচো। লোকে আমায় জিজ্ঞেস করে তোমায় এত ইয়ং দেখায় কী করে? কী করে তুমি এত অ্যাক্টিভ থাকো সারাক্ষণ? আমি বলি তার কারণ আমি বাঁচি প্রত্যেক মুহূর্তের জন্য। যখন ঘুমোই, তখন গভীরভাবে ঘুমোই। এই যে এখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এই মুহূর্তটাই এনজয় করছি। আমি তো জানি না এটাই আমার শেষ মুহূর্ত কি না। এ ভাবেই বেঁচে থাকতে হয়।
আমি নিজেকে বোঝাতে একটা শব্দ ব্যবহার করি‘ডিমোশনাল’। আমি ইমোশনাল। কিন্তু সব কিছু থেকেই একটু ডিট্যাচড্। এই দু’টোকে একসঙ্গে করেই নিজেকে বলি ‘ডিমোশনাল’। জীবনকে আমি একটু দূর থেকে দেখি, অথচ সেই জীবনেই যে কাজগুলো করি, তার প্রত্যেকটার সঙ্গে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকি। এটার একটা বড় কারণ খুব কম বয়সে মা-বাবাকে হারানো। আমার ব্যাপারে অনেকের সমস্যা আছে কারণ আমি খুব একটা সামাজিক নই। সামাজিক সম্পর্কগুলো আমি কাঁধে নিয়ে ঘুরি না। আমি জানি মৃত্যু আসবেই। জীবনের এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাই আমার একটাই লক্ষ্যযাবার আগে যেন নিজের সন্তানদের কাছে শিক্ষণীয় একটা উদাহরণ হয়ে উঠতে পারি। একমাত্র এই লক্ষ্যটাই এখন আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। |