স্মরণ ১...
ঝরা পাতা বর্ষ
৪ বছরের বাম জমানার ‘পরিবর্তন’ ঘটানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনশন-করা অণ্ণা হজারে? ‘ডার্টি’ বিদ্যা বালন? নাকি ফেসবুক এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে ভর দিয়ে ছড়িয়ে পরা অহিংস ‘জুঁই-বিপ্লব’, যার দাপটে ইয়েমেন থেকে মিশর, তিউনিসিয়া, সুদান, ইয়েমেন, মরক্কো... বহু দেশেই থমকে গেল অগণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা? ৩১ ডিসেম্বরের সকালে কে আজ হতে পারে ফেলে-আসা বছরের সেরা মুখ?
সমস্ত হিসাব তছনছ করে দিচ্ছে এক জনই। মৃত্যু! বছরের শেষ দিকে আমরি-কাণ্ডে ৯২ জন, সংগ্রামপুরে বিষমদ খেয়ে ১৭০ জন। শুধুই সংখ্যা? জোসেফ স্তালিন এক বার বলেছিলেন, “একটি মৃত্যু ট্রাজেডি। আর বহু মানুষের মৃত্যু পরিসংখ্যান।” স্তালিন অবশ্য অত্যাচারী একনায়ক ছিলেন, তাঁর কথার প্রেক্ষিতও অন্য রকম ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ায় তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাধব-বাধব করছে, ইউক্রেনে দুর্ভিক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে সে রকম একনায়কতন্ত্র, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা মহামারী ছিল না। বছরের মাঝামাঝি দার্জিলিং এবং প্রতিবেশী সিকিমে বহু মানুষ ভূমিকম্পে শেষ হয়ে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সে ছিল প্রকৃতির খেয়াল।
অথচ, বছর শেষের ওই ৯২ আর ১৭০? বাঁচার আশায়, অসুস্থ শরীরে কেউ ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। কেউ বা হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে স্বস্তির তাগিদে চুমুক দিয়েছিলেন পানপাত্রে। কিন্তু ‘বাঁচার আশা’ এবং ‘স্বস্তির তাগিদ’ দুটোই হয়ে দাঁড়াল মৃত্যুর দূত! “যমদূতেরা এ বার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সময়টা হয়ে গেল মৃত্যুর বছর,” বলছিলেন ‘আফটারনুন রাগা’-র লেখক অমিত চৌধুরী।
মৃত্যু কোথায় না ছিল? এই বছরেই মারা গেলেন মকবুল ফিদা হুসেন, শাম্মি কপূর, দেব আনন্দ, সুচিত্রা মিত্র এবং এলিজাবেথ টেলর। এঁদের মধ্যে হুসেনই সর্বজ্যেষ্ঠ, কট্টর হিন্দুত্বের চাপে দেশছাড়া হয়েও ৯৫ বছর বয়সে রং তুলি নিয়ে চমৎকার ব্যাটিং করছিলেন। আর সবচেয়ে ছোট লিজও অসুখে ভুগতে ভুগতে ৭৯ বছরের চৌকাঠ পেরিয়ে গিয়েছিলেন। বার্ধক্যে এই সব মৃত্যু শোকের, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। জীবনের নিয়ম!
নিয়ম? তা হলে ৫৫ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতে ক্যান্সারে শেষ হয়ে গেলেন কেন ওই ভদ্রলোক? জিন্স, টি শার্টের সঙ্গে স্নিকার পায়ে আর কোনও দিনই আইপড, আইফোন নিয়ে হাজির হবেন না স্টিভ জোব্স। কেন লন্ডনের ফ্ল্যাটে মদ আর কোকেনের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা গেলেন গায়িকা অ্যামি ওয়াইনহাউস? ফেলে-আসা ২০১১ সালে মৃত্যু বারে বারেই দেখিয়েছে, তার কাছে তারুণ্য-বার্ধক্য, খ্যাতি-অখ্যাতি সব হিসাবই তুচ্ছ। মৃত্যু এবং হিংসার রাজনীতিকে যারা পাথেয় করে, তাদেরও নিস্তার নেই। সে কারণেই শালবনির জঙ্গলে পড়ে থাকে কোটেশ্বর রাও ওরফে ‘কিষেনজি’র গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। আর বছরের শুরুতে? পাকিস্তানের পাহাড়ি শহর অ্যাবটাবাদের দোতলা এক বাংলো বাড়ি ঘিরে ভোররাতে মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসেন কম্যান্ডোরা, মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান ওসামা বিন লাদেন।
কিষেনজি বা ওসামা বিন লাদেন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেননি। কিন্তু লিবিয়ার মুয়াম্মর গদ্দাফি? চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনিই ক্ষমতার শীর্ষে। আর তাঁর ইচ্ছাতেই সে দেশে ছিল না সংবিধান। ছিল না গণতন্ত্র। রাজনৈতিক দল, ভোটাভুটি সবই সেখানে তখন নিষিদ্ধ। ছিল না প্রশাসন, বিচারবিভাগ ইত্যাদির পৃথক অস্তিত্ব। ছিল শুধু কয়েকটি ‘জনসাধারণের কমিটি’। আর সবার ওপরে গদ্দাফি ও তাঁর ১২ জন সদস্যের ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’। সেই স্বেচ্ছাচারী ইতিহাসও জনরোষে শুকনো পাতার মতো ঝরে গেল এ বার।
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার!...ক্রিকেট, গ্ল্যামার, সম্পাদনা, জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার শূন্য করে চলে গেলেন মনসুর আলি খান পটৌডি। দুর্ঘটনায় ডান চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ভারতীয় টেস্ট দলের সবচেয়ে কমবয়সী ক্যাপ্টেন। তাঁর ছত্রছায়াতেই ভারতীয় ক্রিকেটে ঘুচে গিয়েছিল জাতপাত, শ্রেণিবৈষম্য আর আঞ্চলিক বিভাজন। শুরু হল মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে-আসা সোলকার, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথদের উত্থান। তাঁর প্রেরণাতেই জাতে উঠল ভারতীয় ফিল্ডিং। ভারতীয় মহাকাব্যে কর্ণ এবং গ্রিক ট্রাজেডির ইডিপাস দু’ জনেই ভাগ্যের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পটৌডি ভাগ্যের কাছে হার মানেননি, কিন্তু মৃত্যুর কাছে নতি স্বীকার করতেই হল।
খেলার দুনিয়ায় এই বছরে মৃত্যুর কাছে কত যে হার! লিভার ক্যান্সারের কাছে মাত্র দু মাসের লড়াইতে নক আউট হলেন জো ফ্রেজিয়ার। জীবনের রিং ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। চলে গেলেন ’৮২-র বিশ্বকাপের ব্রাজিল টিমের সক্রেটিস। তাঁর পরে ফুটবলের মাঠ রোনাল্ডো, বেকহ্যাম, জিদান অনেকের স্টাইল দেখেছে। কিন্তু ধূমপায়ী, মদ্যপায়ী সক্রেটিস তো অন্য জিনিস। শুধু বিশ্বকাপার নন, ডাক্তার এবং কলমচি। ব্রাজিল-রাজনীতিতে গণতন্ত্রের দাবিতে সরব। বর্ণময় এই জীবনও মৃত্যুর কাছে আজ ধূসর।
গানের জগতেও একের পর এক শোকগাথা। ‘হোঠো সে ছুলো তুম’! মোটর দুর্ঘটনায় একমাত্র পুত্রের মৃত্যুশোক কাটিয়ে ক্রমে জগজিৎ সিংহ ফিরে এসেছিলেন গানে। তাঁর স্ত্রী চিত্রা শোকের কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরোতে পারেননি।
কিন্তু জগজিৎ সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন, ‘হাজার বার রুকে হম, হাজার বার চলে।’ তিনিও রিক্ত পাতার মতো খসে গেলেন।
জগজিৎ নেই, চলে গেলেন ‘হে দোলা’ গানের ভূপেন হাজারিকা। কিরানা ঘরানার ভীমসেন জোশীও মারা গিয়েছেন এই বছরেই। শীতের দুপুরে এখনও রাস্তার মোড়ে বেজে ওঠেন দেবব্রত, ‘বহু যুগের ও পার হতে আষাঢ় এল’। মনে পড়ে, সুচিত্রা মিত্রকে বসন্তকালে এক অনুষ্ঠানে ‘কৃষ্ণকলি’ গাইতে বলা হল। তাঁর সাফ উত্তর, “বসন্তের গান শুনুন। কৃষ্ণকলি এখানে মানায় না।” সেই রাবীন্দ্রিক দার্ঢ্য বিদায় নিল, বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গেল।
কেন এত মৃত্যু? মুম্বই থেকে ফোনে জ্যোতিষী বেজান দারুওয়ালা বলছিলেন, “এ বার তুলারাশিতে শনির প্রবেশ ছিল। শনি মানেই শেষ বিচার এবং মোক্ষলাভ।”
গীতায় শুধু মোক্ষের কথা নেই। আছে, ‘মা ফলেষু কদাচন।’ ফলের কথা না ভেবে নিস্পৃহ, নিরাসক্ত হয়ে কাজ করে যাও! লন্ডনের হোটেলে আচমকা দেব আনন্দের মৃত্যু। তার আগে প্রায় দুই দশক ধরে তাঁর তৈরি সব ছবির বক্স অফিস থেকে নিঃশব্দ বিদায়। কে বলে, দেব আনন্দ মানেই মাথায় হ্যাট আর গ্রেগরি পেকের নকলে ঘাড় ঝোঁকানোর পাশ্চাত্য কেতা! তিনি গীতার সেই নিস্পৃহ কর্মযোগী।
দেব চলে গিয়েছেন, ষাটের দশকের অদম্য স্ফূর্তি আর প্রাণশক্তি নিয়ে চলে গিয়েছেন শাম্মি কপূরও। কেউ আর লাফিয়ে বলবে না ‘চাহে কোই মুঝে জংলি কহে।’
এত মৃত্যুর কোনও সান্ত্বনা নেই। উপনিষদ জানিয়েছিল, দেহ চলে যায়, কিন্তু আত্মা অমর। অস্ত্র তাকে বিঁধতে পারে না, আগুন তাকে দাহ করতে পারে না। সেই আপ্তবাক্যেও আর সান্ত্বনা নেই। আগুন যাকে পোড়াতে পারে না, বিষ-চোলাই যার এতটুকু প্রাণশক্তি কাড়তে পারে না, সেই অমর আত্মা আর কেউ নয়। বাঙালির দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।
শেষ হয়ে গেল ‘অন্য স্বর’ও। এই বছরেই মারা গেলেন ক্রিস্টোফার হিচেন্স। ঈশ্বর মানতেন না, মহাত্মা গাঁধী থেকে মাদার টেরিজা প্রায় সকলের বিরুদ্ধে লিখে গিয়েছেন, মদ আর সিগারেটের নেশায় জীবনটা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আপনি একমত হোন বা নো হোন, অস্বীকার করা যায় না হিচেন্সের বিকল্প চিন্তার গুরুত্ব। মঞ্চের বাইরে খোলা মাঠে, ফুটপাথে ‘থার্ড থিয়েটার’-এর যে বিকল্প চিন্তা? বঙ্গভূমে তার স্রষ্টা বাদল সরকারও চলে গেলেন এই বছরেই।
চলে গেলেন চেক প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ভাক্লাভ হাভেল। পশ্চিমবাংলায় এক নাট্যকার এখন মন্ত্রীর আসনে। কিন্তু ভাক্লাভ হাভেলই একমাত্র নাট্যকার, যিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আজকের জুঁই বিপ্লবের ঢের আগে, তাঁর নেতৃত্বেই চেকোস্লোভাকিয়ার অহিংস ‘ভেলভেট বিপ্লব’। কমিউনিস্ট আমলে বারংবার জেলে গিয়েছেন, বাম বিদায়ের পর তিনিই প্রেসিডেন্ট। তাঁর আমলেই দেশটি চেক প্রজাতন্ত্র আর স্লোভাকিয়া নামে দুই ভাগে ভেঙে যায়। নতুন চেক প্রজাতন্ত্রেও ভোটে জিতে তিনিই হলেন প্রেসিডেন্ট। ‘জুঁই বিপ্লব’-এর বছরেই মারা গেলেন সেই হাভেল। তবু মায়া রহিয়া গেল!
মায়া? এই বছরেই মাতৃহারা হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মা-কে হারিয়েছেন হিলারি রোডহ্যাম ক্লিন্টন এবং জর্জ বুশ জুনিয়রও। সর্বত্র শুধু মাতৃশোক!
জীবনের বাইরে ‘প্রতীকী’ মৃত্যুও যে কত! দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নিজস্ব মডেলের ‘লোকপাল’-এর দাবিতে অণ্ণা হজারের সত্যাগ্রহ এ বার হিট। কিন্তু নির্বাচিত সংসদকে চাপে ফেলে, গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রকরণে অণ্ণার আন্দোলন কোনও দিশা দেখায় না। বছরশেষে তিনিও হতে পারলেন না জীবনের প্রতীক।
মনে পড়ে, আমরা-ওরার এই রাজ্যে ‘রাজনৈতিক সৌজন্য’ ক্রমে জীবন ফিরে পাচ্ছিল। কিন্তু বছরশেষে ‘জলে বিষ’ বিতর্ক প্রমাণ করে দিল, ওই সৌজন্যও ছিল নিতান্ত ক্ষণজীবী।
মৃত্যু-আক্রান্ত বছর শেষ হতে চলেছে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাদে। রাত বারোটার পর ২০১১ নিজেই খসে পড়বে অতীতের কৃষ্ণগহ্বরে। তার আগে একটাই প্রার্থনা! ‘হে ২০১২, অন্ধকার থেকে আমাদের আলোয় নিয়ে যাও। নিয়ে চলো মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে।’ মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়ঃ!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.