বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ। গ্রিস থেকে মিশর, লিবিয়া থেকে লন্ডন, রাশিয়া থেকে ওয়াল স্ট্রিট, এমনকী হাতের কাছে অণ্ণা হজারে। বছরটাই প্রতিবাদের। কোথাও ছোট-বড় ঢেউ, কোথাও একেবারে সুনামি!
কিন্তু বাঙালি? তারা কি ‘বিশ্ব-বিমুখ’? মোটেই না। কে দেয় এমন অপবাদ? বরং এই প্রতিবাদের বছরে ‘বিশ্ব সাথে যোগে’ তারও সরব উপস্থিতি। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম-রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে মহাকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরিবর্তন’-এর সরকার ক্ষমতায় আসা তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন। প্রচেষ্টা ছিল দীর্ঘদিনের। ‘সফল’ হওয়ার ইঙ্গিতও স্পষ্ট হচ্ছিল ক্রমশ। তবু শেষ উত্তর জানার জন্য দেশবিদেশের চোখ ছিল ২০১১-এর দিকে। ১৩ মে-র নির্বাচনী ফল জানিয়ে দিয়েছে, বাঙালি তার ‘প্রতিবাদী সত্তা’ হারায়নি।
সরকারের প্রথম ৬ মাসের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে দুটি সিদ্ধান্তকেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফল প্রতিবাদী পদক্ষেপ বললে ভুল হবে না। শিক্ষায় রাজনীতিকরণ এই রাজ্যের কপালে গত কয়েক দশক ধরে কলঙ্করেখার মতো লেপ্টে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালন ব্যবস্থায় দলতন্ত্র কায়েম করার সেই পদ্ধতি ছিল প্রয়াত সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাসের উদ্ভাবন। বিরোধিতা-সমালোচনা কোনও কিছুতেই কিছু হয়নি। ক্ষমতায় এসেই তাঁর শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বদল ঘটিয়ে সেই ‘অনিলায়তনে’ ঘা মারলেন মমতা।
একই ভাবে প্রেসিডেন্সি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার পথে এগিয়েও সেখানে ‘অনিলায়ন’ সূত্রের সূক্ষ্ম প্রয়োগে রাজনীতির (অর্থাৎ, শাসক দলের) নিয়ন্ত্রণ রেখে দিয়েছিল পুরনো সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা পরিবর্তন এনেছেন তাতেও। শিক্ষার উৎকর্ষকে প্রাধান্য দিতে শিক্ষাক্ষেত্রের বিশিষ্টদের নিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তৈরি হয়েছে মেন্টর গ্রুপ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অমর্ত্য সেন, সুগত বসুর মতো প্রাক্তনী। |
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওই দুই সিদ্ধান্ত যদি হয় প্রতিবাদের প্রতীক, ‘ঈশ্বর কণা’ (গড-পার্টিকল্) খোঁজার জন্য বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীদের গবেষণা তা হলে ফের প্রমাণ করে দিতে পারে যোগ্য স্বীকৃতি না-পাওয়া বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর শ্রেষ্ঠত্ব। এবং উস্কে দিতে পারে একটি প্রতিবাদী প্রশ্ন, কেন তিনি তাঁর সাধনার প্রাপ্য মর্যাদা পাননি?
এ বছরের প্রান্তসীমায় এসে যখন ‘ঈশ্বর কণা’ নিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানজগতে তোলপাড়, তখন আরও এক বার অনিবার্য ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন প্রায় চার দশক আগে প্রয়াত সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পণ্ডিতেরা জানেন, হিগস্-বোসন কণার অস্তিত্ব বিনা ‘ঈশ্বর কণা’-র অনুসন্ধান সম্ভব ছিল না। আরও বড় কথা, হিগস্ ১৯৬৪ সালে যে কণার অস্তিত্ব কল্পনা করেছিলেন, তার আগাম আভাস কুড়ির দশকেই দিয়ে রেখেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ। তাঁর নামাঙ্কিত ‘বোসন’ নিয়ে গবেষণা করে পরবর্তী কালে অনেকে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছেন। কিন্তু স্বদেশে-বিদেশে তাঁর ওই যুগান্তকারী আবিষ্কারের উপযুক্ত সম্মান সত্যেন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়নি। ২০১১ আরও একবার সেই কথা মনে করিয়ে দিল।
এই বছরটি আর এক বাঙালি বিজ্ঞানসাধক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মসার্ধশতবর্ষ। রয়্যাল সোসাইটি ‘শ্রদ্ধা’ জানিয়েছে তাঁকে। উল্লেখ থাক মার্কিন-প্রবাসী বাঙালি সৌরেন্দু গুপ্তের কথাও। ‘বিগ ব্যাং’-এর পরে তৈরি হওয়া শক্তি থেকে পদার্থে রূপান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ কাজ এই বছরেই স্বীকৃতি পেয়েছে ‘সায়েন্স’ পত্রিকায়। ২০১১-এর খবর, অবশেষে শুরু হচ্ছে ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের নিয়ে ১১০০ কোটি টাকার ‘নিউট্রিনো গবেষণা প্রকল্প’, যার সামনে বঙ্গসন্তান নবকুমার মণ্ডল।
দারিদ্র নিয়ে একটি বই লিখে অর্থনীতির দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন এম আই টি’র অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। সচরাচর যে ভাবে দারিদ্রের সঙ্গে মোকাবিলা করার কথা ভাবা হয়, এই বই সেই চেনা পথে হাঁটেনি, বরং কিছুটা ‘প্রতিবাদী’ হয়ে তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্রকে একেবারে নতুন চোখে দেখেছে। এসথার দুফলো’র সঙ্গে যৌথ ভাবে লেখা ‘পুয়োর ইকনমিক্স’ প্রকাশ পেয়েছে এই বছরেই। অভিজিৎবাবু প্রেসিডেন্সির মেন্টর গ্রুপেরও অন্যতম সদস্য হয়েছেন।
দারিদ্র দূর হলে অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার ভরে ওঠে। আর যেখানে ‘অন্নপূর্ণা’, সেখানেই তো বঙ্গরমণী। গত সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত দেনা ব্যাঙ্ক-এর চেয়ারপার্সন ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কার্যভার নিয়েছেন নূপুর মিত্র।
চলে যাওয়া বছরটা তার প্রতিবাদী চরিত্রের বেশ কিছু ছাপ রেখে গিয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষে তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বই ‘আপনি তুমি রইলে দূরে...’ সেই তালিকায় এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। কারও জীবনভিত্তিক কিছু লেখার সময়ে ‘অপ্রিয়’ সত্যের প্রতি নির্মোহ বিশ্বস্ততা রক্ষা করতে বাঙালির অনীহা প্রায় চিরকালীন। যে কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবনকে যত দূর সম্ভব ‘অবিতর্কিত’ এবং সব দিক থেকে ‘আদর্শ’ হিসাবে তুলে ধরার দৃষ্টান্তই তাই বেশি।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শান্তিনিকেতনের এক শিক্ষক নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের তথ্য সম্বলিত এই বইটি এ বার এক নতুন ধারার সূচনা করল। বইয়ের তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করেছেন স্বয়ং মীরাদেবীর পুত্র। যার পরতে পরতে রয়েছে এক সুন্দরী যুবতী পরস্ত্রীর সঙ্গে এক প্রৌঢ়ের উষ্ণ-নিবিড় যোগাযোগের বহু অজানা ঘটনা। প্রকাশিত তথ্যে এমনও দেখা যায়, রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকাকালীন জ্বরের সময় গা স্পঞ্জ করে দেওয়ার জন্য রীতিমতো হাতচিঠি লিখে মীরাদেবীকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। লিখছেন: “জানি না তোমার অভ্যাস আছে কি না... যদি অভ্যাস না থাকে তো জানিও। আমি নিজে ম্যানেজ করে নেব...।”
এমন একটি বই বাঙালির খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসা প্রতিবাদী মানসিকতার প্রকাশ বই কি! শুধু লেখক নয়, বইটির জন্য তথ্য জুগিয়ে নজির গড়েছেন মীরাদেবীর পুত্র জয়ব্রতও।
সিনেমার পর্দায় প্রতিবাদের সেরা ঝলক এ বার পাওলি দাম। এদেশের সেন্সর বোর্ড ছাড় না-দিলেও কাহিনির স্বার্থে ক্যামেরার সামনে নিজেকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে শয্যাদৃশ্যে পাওলির অভিনয় তাঁকে এবং একই সঙ্গে বাংলা সিনেমা জগতকে ‘সাবালকত্বের’ পথে অনেকটা এগিয়ে দিতে পেরেছে। ‘ছত্রাক’ ছবিতে পাওলির ওই শয্যাদৃশ্য নিয়ে বিতর্ক অবশ্য কম হচ্ছে না। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে, গত দু-তিন বছরে বাংলা সিনেমা তার পুরনো স্থবিরতা ঝেড়ে ফেলে যে ভাবে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে, পাওলি দামের এই সাহসী পদক্ষেপে তা আরও গতি পাবে।
পাচ্ছে বলেই তো বাংলা সিনেমার নাম দেওয়া যায় ‘গান্ডু’। সংলাপে ‘বিশুদ্ধতার’ ছুৎমার্গ শিকেয় তুলে ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখতে ভিড় উপচে পড়ে। মা-ছেলের সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে তৈরি ‘ইচ্ছে’ জনপ্রিয়তা পায়। এ সবই এই বছরের প্রাপ্তি।
খেলায় প্রাপ্তির ভাণ্ডারে কিন্তু এ বার মা ভবানী। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচে ইডেনের খাঁ খাঁ চেহারাও কি তবে প্রতিবাদের অন্য কোনও ছবি? বুঝিয়ে দেওয়া যে এটা আর লোক টানবে না? যুবভারতীতে বড় ম্যাচে ফের বিদ্যুৎ বিভ্রাট বাড়িয়েছে লজ্জার মাত্রা।
মহাকরণে ‘পরিবর্তনের সরকার’ আসার পরে রাজনীতিতে বলার মতো তেমন কিছু ঘটেনি। তবে পুলিশের গুলিতে মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজির মৃত্যু ‘প্রতিবাদ’ ব্যাপারটিকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। বিষয়টি দ্বিমাত্রিক। কিষেণজি এবং তাঁদের অনুগামীরা রাজনীতির নামে যে ধরনের হিংসা ও হত্যার পথকে বেছে নিয়েছেন, তাঁদের কাছে সেটাই প্রতিবাদ। আবার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে ভাবে ওই হিংসার মোকাবিলা করেছে, তা রাষ্ট্রের ‘প্রতিবাদ’। যে ভাবে কিষেণজির মৃত্যু হয়েছে, তা গণতন্ত্রের সঙ্গে মানানসই কি না, তা নিয়ে কেউ বিতর্ক তুলতেই পারেন। কিন্তু এর পাশাপাশি ‘খুনের রাজনীতি’র বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা কী হবে, সেই জরুরি প্রশ্নটিও এড়ানো কঠিন। ‘গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ’ বলে যা চলে, তা-ও যে সব সময় গ্রহণযোগ্য এমন কথা কখনওই বলা যাবে না। কিন্তু বাঙালি পরম মমতায় সেগুলিকে লালনপালন করে এসেছে। আজও করে। যেমন, বন্ধ-অবরোধের ‘গণতান্ত্রিক’ পথ এখনও আমাদের প্রিয় বিচরণভূমি। মুষ্টিমেয়র চাপে আজও ধর্মঘট নামক কর্মনাশা ভূত চেপে বসতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠের ঘাড়ে। দিন বদলালেও এই বাঙালি-চরিত্র বদলায় না। সেখানে সে ‘পরিবর্তন-বিরোধী’, আদি, অকৃত্রিম। ‘গণতান্ত্রিক’ ধর্মঘটকে স্থান করে দিতে তাই পরীক্ষার দিনটাই বদলে যায়!
২০১১-র শেষবেলায় আরও এক বার এ ভাবেই নিজেকে চেনার ‘সুযোগ’ পেল বাঙালি। |