পুস্তক পরিচয় ১...
অরণিটি যেন হারিয়ে গিয়েছে
ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার? গৌতম ভদ্র। ছাতিম বুক্স্, ১৮০০.০০
(সঙ্গের ক্যালেন্ডার চিত্রটি বই থেকে নেওয়া)
ই দিয়েই শুরু করা যাক।
গৌতম ভদ্রের গৌরচন্দ্রিকার শুরুও ‘টই’ দিয়েই। তাঁর ‘সন্দর্ভের বিষয় বই-টই, বিশেষত বাংলা বই-টই।’ বস্তুত এই ‘টই’ তাঁর একটি বড় হাতিয়ার। ধরাবাঁধা, প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার জোয়াল নামিয়ে ফেলে গবেষণার উদারতর পরিসরে বিচরণের হাতিয়ার। এবং ‘টই’ আলোচ্য ন্যাড়া-য় একটি অমোঘ চুম্বকও, বিবিধ জ্ঞানকে যা জড়ো করে আনে।
‘টই’ যদি হয় অনুষঙ্গ, ভদ্রের কথায় ‘গাছের ছায়া’, ‘বই’টি তবে কী? বইয়ের নাম ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার? কৃতজ্ঞতা স্বীকার, গৌরচন্দ্রিকা, নির্দেশিকার পরে এ বইয়ের মূল পাঠের তিনটি ভাগ ‘নিবন্ধাবলী’, ‘আর্কাইভস-কথা: প্রসঙ্গ ও প্রতর্ক’, ‘কী দেখি, কী পড়ি’। আর্কাইভস-কথা মূলত ডকুমেন্টেশন। কী দেখি, কী পড়ি-তে ‘বই দেখা আর ছবি পড়া’ নামে একটি নিবন্ধ এবং টীকা-সহ শতাধিক ছবি। প্রথম পর্ব, নিবন্ধাবলী-তে পাঁচটি নিবন্ধ ‘বাংলা পুথি-তালিকা নির্মাণ ও আত্মসত্তার রাজনীতি: মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ’, ‘বাঙালির বাংলা বই পড়া’, ‘উনিশ শতকে বাংলা বইয়ের বিজ্ঞাপন’, ‘পাদটীকার পাদদেশে’ এবং ‘ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার?’। কিন্তু নিবন্ধগুলি কি প্রথম পর্বের অধ্যায়? যদি তা হয় তবে একটি স্পষ্ট যোগসূত্র থাকতে হবে। তা না হলে প্রশ্ন উঠবে, বইটির নাম ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার? হবে কেন?
নিবন্ধাবলির মধ্যে একমাত্র নাম-নিবন্ধটিতেই ‘বটতলা’ বিষয় হয়ে উঠেছে, বাকিগুলিতে ‘বটতলা’ নেহাত ‘আশয়’ (আশ্রয় অর্থে নয়)। অর্থাৎ সেখানে বটতলা কয়েক বার এসেছে বা আনা হয়েছে। তবু যে-বইয়ের বিষয়আশয় বটতলা-টটতলা কিংবা বই-টই তার সঙ্গে ন্যাড়ার বটতলায় যাওয়ার সম্পর্কটা কী? গৌরচন্দ্রিকা-য় লেখকের যুক্তি: ‘উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের বাংলা বই-টই-এর ঝাপসা জগতে হাতড়ে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম ‘বটতলা’ বলে কিছু-মিছুতে বার বার ঠেকে গেছি। কখনো-বা সস্তা বাজারি মুদ্রণ-অর্থে, কখনো-বা পাঠরুচির বিকার অর্থে, ...‘টই’ হিসাবে ‘বটতলা’ যেন বাংলা বইয়ের গায়ে লেপ্টে আছে।’ আবার তিনি লিখছেন, ‘প্রথম পর্বের অধ্যায়গুলি সব স্বতন্ত্র নিবন্ধ, নানা উপলক্ষে লেখা ও পড়া; এহেন সংকলনকে সন্দর্ভের আকার দেবার তাগিদে নিবন্ধগুলি আদ্যন্ত পুনর্মাজিত, পরিবর্ধিত ও পুনর্লিখিত হয়েছে। ফলে আমার একটি নিবন্ধনামই গোটা সন্দর্ভের সংজ্ঞার্থ রূপে প্রযুক্ত হল, ঐ নামেতে বই-এর আঁটোসাঁটো অর্থের মধ্যে ‘টই’-এর আলগা মেজাজও যেন ধরা পড়ে; ভরসা করি, আজকালকার উত্তর আধুনিকতাবাদে নিষ্ণাত কালচারাল স্টাডিজ-এর কুন্তকরা এতে আপত্তি করবেন না।’ লক্ষণীয় বলার ভঙ্গিটা আর তার নিহিত সংশয়ছায়াগুলি। ‘অধ্যায়’-এর সঙ্গে ‘স্বতন্ত্র নিবন্ধ’; ‘সংজ্ঞার্থ’-এর সঙ্গে ‘আলগা মেজাজও যেন’... বস্তুত গোটা গৌরচন্দ্রিকাটাই বইটির নামকরণের সার্থকতা প্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্ত। যে বইয়ের নাম তার পাঠ এবং শরীর থেকে আপনি উঠে আসে না, বইয়ের শুরুতেই কসরত করে লেখককেই প্রতিষ্ঠা করতে হয় নামকরণের সার্থকতা, জোর করে তৈরি করতে হয় কোনও একসূত্র সে বইকে তবে নিছক নিবন্ধ-সংকলন হিসেবে উপস্থিত করা হবে না কেন? নাকি বইটির গা থেকে সংকলন-সংকলন গন্ধটি মুছে দেওয়ার জন্যই এত আয়োজন?
অথচ, সাংস্কৃতিক চিন্তনের ধরাবাঁধা ছকের বাইরে ওই আলগা মেজাজ, আলোচনার ওই এলানো গড়নটাই তো ভদ্রমহোদয়ের বৈশিষ্ট্য। বাঙালির বাংলা বই পড়া-র সূত্রে স্বেচ্ছাচারী পড়ুয়া রল্যাঁ বার্তের কথা আনেন তিনি, যথেষ্ট আয়াসে বাঙালি পাঠকের বাংলা বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে বলতে বলতে চলে যান আনন্দবর্ধন-অভিনবগুপ্তের সাহিত্যতত্ত্বে। এমনকী চিৎপুর-গরানহাটা-বটতলার নিশানা ধরেই আব্দুল করিমের সারস্বত-সাধনার শুরু বলেই তাঁর পুথিচর্চাকেও তিনি এনে ফেলেন বটতলার পরিসরে! জ্ঞানচর্চার এই শৃঙ্খলহীন বিস্তারকেও আঁটাতেই হবে সন্দর্ভের কোনও আঁটোসাঁটো সংজ্ঞার্থে?
সেই চেষ্টাটা না করলেই এ বই তার যথাযোগ্য মর্যাদায় স্থিত হতে পারত। আর সেটা হলে পাঠকের প্রতি এই বিভ্রান্তির অবিচারটাও করা হত না যে বইটা বটতলা নিয়ে কোনও নতুন গবেষণা। নাম-নিবন্ধটি বটতলা নিয়েই, সুকুমার সেন, শ্রীপান্থ, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপ্তী রায়, অনিন্দিতা ঘোষ প্রমুখের পরে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণার ফসল। শুধু সেটিই নয়, স্বতন্ত্র ভাবে এর বাকি পূর্বপ্রকাশিত এবং পুনর্মার্জিত নিবন্ধগুলিও জ্ঞানচর্চায় নতুন কথা বলে। জ্ঞানের এই বিশ্ব যেন লেখকের করতলগত আমলকী। কিন্তু মুশকিল হল, সেই আমলকী নিতান্ত দুষ্পাচ্য। যে ভাবে লেখক ‘বাঙালির বাংলা বই পড়া’ নিবন্ধে ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের সবিস্তার আলোচনা ফেঁদে বসেন, ঢুকে যান সাহিত্যসমালোচনার জগতে তাতে এই প্রশ্নটি ওঠে যে ‘বই পড়া’ আর ‘সাহিত্য পড়া’ কি একই? সাহিত্যতত্ত্বও গ্রন্থবিদ্যা-য় ঢুকে পড়বে এবং অধিকার করবে আলোচনার অধিকাংশ? বস্তুত বিবিধ বিদ্যার অরণ্যে বহু পরিশ্রমে তিনি সংগ্রহ করে এনেছেন দুর্লভ জ্ঞানকাণ্ডগুলি, কিন্তু অরণিটি যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।
‘কাকে বলে দুন্দুভি? কাকে বলে অরণি?’ নোটবই পাওয়া যায়, পড়ে উত্তর দেওয়াটা সম্ভব।’ সুকুমার রায় উদ্ধৃত করেছেন লেখকই। কিন্তু তাঁর ন্যাড়াকে বুঝতে হলে জীবনভর ‘বুবোধয়িষা’ নিয়ে ফিরে ফিরে যেতে হবে ছাতিমতলায়, যেতেই হবে, আর তো গতি নাহি রে...
পুনশ্চ এক: নির্দেশিকা বলছে, ‘বই-ছবি দেখার সময় মনে রাখা প্রয়োজন যে সন্দর্ভে সন্নিবেশিত চিত্রসমূহের প্রতিরূপ রঙ ও রেখায় উৎসানুগ।’ অনেক ছবির পীত আবহ এ বিষয়ে সন্দেহ জাগায়।
পুনশ্চ দুই: এ বইয়ের সবচেয়ে উপভোগ্য অংশ সটিপ্পন চিত্রাবলি, বার্ত-কথিত বইয়ের সঙ্গে ‘জুইসাঁস’ সেখানেই ঘটে। শ্রীভদ্র ফরাসি সঙ্গমাত্মক শব্দটিকে ‘শীর্ষসুখ’ বুঝেছেন, আমি বলি, ‘পরম রমণ’।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.